কিংবদন্তী রাজনীতিকের চিরপ্রস্থান

0
481

এম জে ফরাজী:
‘জন্ম হলেই তার মৃত্যু অনিবার্য’ চিরন্তন সত্য এ কথাটি জেনেও কিছু মৃত্যু মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। মানতে বড় বেশী কষ্ট হয়, তার কারণ তারা আরো কিছুদিন জীবিত থাকলে সমাজকে আরো ভাল কিছু দিতে পারতেন। সেই রকম একজন খুলনার অভিভাবক, সকলের প্রিয় ভাইজান, খুলনা- ৪ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে সিঙ্গাপুরে অর্চিডে অবস্থিত মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেছেন বলে তাঁর পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেছে (ইন্না লিল­াহি …. রাজিউন)।
এমপি সুজা’র পারিবারিক সূত্র জানায়, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আট মাস আগে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। ১৮ জুলাই আবার চিকিৎসার জন্য তিনি সিঙ্গাপুরে যান। সিঙ্গাপুরে সুজার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
তার মৃত্যুতে খুলনাবাসী হারালো একজন ভাল অভিভাবক প্রিয় ভাইজানকে। যে অভিভাবকের কাছে দলমত নির্বিশেষে সকলেই অভিযোগ করতে পারতেন, তিনিও শুনতেন সকলের কথা।
জেলা আ’লীগের দপ্তর সম্পাদক এ্যাড. ফরিদ আহমেদ জানান, সুজার একমাত্র ছেলে এস এম খালেদীন রশিদী সুকর্ন বাবার মরদেহ আনতে শুক্রবার সকালে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। সেখান থেকে কবে নাগাদ মরদেহ দেশে আসবে সেটি সুকর্ন সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে। এরপর দাফন কাফনের সময় জানানো হবে।
এদিকে তার মৃত্যুর সংবাদে খুলনার আওয়ামী পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়, খুলনা জেলা ও মহানগর নেতৃবৃন্দ পৃথকভাবে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন : প্রয়াত এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা ১৯৭৭ সালে প্রথম পৌর কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই একই সময় বর্তমান নবনির্বাচিত কেসিসি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক পৌর কমিশনার নির্বাচিত হন। সুজা ১৯৮৬ সালে খুলনা-২ থেকে এমপি নির্বাচন করেছিলেন (এরশাদের শাসন আমল)। ১৯৯১, ৯৬ ও ২০১৪ সালে তিন দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন পদ্মার এপারের জননন্দিত এই নেতা। ১৯৯৬ সালে ছিলেন জাতীয় সংসদের সরকার দলীয় হুইপ।
২০০২ সালে যৌথ বাহিনীর অপারেশন ক্লিনহার্টে গ্রেফতার হন। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের ইশারায় তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। দীর্ঘদিন ছিলেন চিকিৎসাধীন। ১/১১ এ তত্ত¡াবধায়ক সরকার মামলা দিলে প্রবাস জীবন কাটান, ফলে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি। পরে হাইকোর্ট থেকে খালাস পান।
১৯৯১ সাল থেকে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে তিনি খুলনা-২ আসনে এমপি পদে নির্বাচন করেন। ওই সময় তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৬ সালের পর দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জেলা আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হন।
১৯৭২ সালে শেখ কামাল আবাহনী ক্রীড়াচক্র গঠনকালে ইলিয়াস চৌধুরী প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মোস্তফা রশিদী সুজা প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারন সম্পাদক ছিলেন। ইলিয়াস চৌধুরির মৃত্যুর পর তিনি সভাপতি হন আবাহনী ক্লাবের।
খুলনা নাট্য নিকেতনের সভাপতি ছিলেন। তিনি একজন নাট্য অভিনেতাও ছিলেন। তেরখাদার চিত্রা মহিলা কলেজ, দিঘলিয়ার মোস্তফা রশিদী সুজা মহিলা কলেজ, রূপসা মহিলা কলেজ সহ অসংখ্য মাদ্রাসা, মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন এই জনপ্রতিনিধি।
১৯৯৩ সালে পাঠকের কাগজ প্রকাশ করেন, শেখ হাসিনা উদ্ভোধন করেছিলেন পত্রিকাটি। অবশ্য ২০০৬ সালে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রকাশক হিসেবে গত দেড় বছর আগে আবার পাঠকের পত্রিকা নামে নতুন করে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। ছেলে এস এম খালেদীন রশিদী সুকর্ত এই পত্রিকার সম্পাদক।

 

শোকে স্তব্ধ খুলনা:
দীর্ঘদিন ধরে খুলনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা এমপি’র মৃত্যুর সংবাদ শুনে শোকাতুর হয়ে পড়েছেন তার সহযোদ্ধা, ভক্ত, কর্মীসহ সর্বস্তরের লোকজন। এ যেন শোকে স্তব্ধ খুলনা। নগরী কিংবা গ্রাম, প্রত্যেক জায়গায় আলোচনায় কিংবদন্তী এ রাজনৈতিক নেতার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। অনেকেরই ভাষ্য, এমপি সুজার মৃত্যুতে খুলনা হারালো আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত নেতাকে। যিনি গড়তে জানেন, জানেন ভালবাসতে। যার ভালবাসার কোন প্রতিদান হয়না। তেমনি এক নেতার প্রয়াণে খুলনাজুড়ে শোকের আমেজ।
এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী ও খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, খুলনা মহানগর আ’লীগের সভাপতি ও কেসিসির নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, জেলা আ’লীগের সভাপতি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ, সংসদ সদস্য ও বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্র শেখ হেলাল উদ্দিন, খুলনা-১ আসনের সংসদ সদস্য পঞ্চানন বিশ্বাস, খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ মো. নূরুল হক, মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজান, বাগেরহাট জেলা আ’লীগের সভাপতি ডা. মোজাম্মেল হোসেন এমপি, সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু।
অনুরূপভাবে শোক প্রকাশ করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান, কুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর, খুলনা জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান, খুলনা জেলা ও নগর জাতীয় পার্টি, জেলা ও নগর যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, খুলনা নাট্য নিকেতন, খুলনা নাগরিক আন্দোলন’র নেতৃবৃন্দ।

 

 

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক:
খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার পৃথক শোকবার্তায় তারা মরহুমের বিদ্রেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
রাষ্ট্রপতি শোকবার্তায় বলেছেন, খুলনা-৪ আসনের এমপি সুজা এলাকার উন্নয়নসহ গণতন্ত্র বিকাশে অবদান রেখেছেন। তিনি খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জাতীয় সংসদে হুইপের দায়িত্ব পালন করেছেন। রাষ্ট্রপতি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অপর এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খুলনা-৪ আসনের এমপি সুজা জনগণের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।

 

স্পিকারের শোক:
খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এসএম মোস্তফা রশিদী সুজার মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এক শোকবার্তায় স্পিকার বলেন, মোস্তফা রশিদী সুজার মৃত্যুতে জাতি একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানকে হারালো। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। মুক্তিযুদ্ধে ও রাজনীতিতে তার অবদান জাতি আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। স্পিকার মোস্তফা রশিদী সুজার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
অপর এক শোকবার্তায় মোস্তফা রশিদী সুজার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বি মিয়া ও চিফ হুইপ আ.স.ম ফিরোজ।

 

 

খুলনা আ’লীগের ৭ দিনের কর্মসূডঢ়:
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক হুইপ এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা এমপি মৃত্যুতে ৭ দিনব্যাপী শোক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে খুলনা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ শনিবার সকাল ৭টায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত করন, কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, দিনব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে কোরআন খতম। কর্মসূচি নগরীর পাঁচ থানা এবং সকল ওয়ার্ড সহ সকল উপজেলা ও ইউনিয়ন একযোগ পালন করবে। এছাড়া এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার মৃতদেহ খুলনায় আসার পরে প্রথমে দলীয় কার্যালয়ে এনে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হবে। পরে শহীদ হাদিস পার্কে জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। জানাযা শেষে টুটপাড়া কবরস্থানে তাঁর বাবা মায়ের পাশে দাফন করা হবে। এছাড়া ৩ আগস্ট শুক্রবার বিকাল ৩টায় শহীদ হাদিস পার্কে নাগরিক শোক সভা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
নাগরিক শোকসভা সফল করতে প্রত্যেক থানা, উপজেলা, ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন যথাযথ ভাবে পালন করার জন্য বিশেষ ভাবে আহবান জানিয়েছেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও নবনির্বাচিত মেয়র আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান এমপি, জেলা আওয়ামী লীগ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. সুজিত অধিকারী।