কাটআউট পদ্ধতিতে মানবপাচারের কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে রাঘববোয়ালরা

0
213

টাইমস ডেস্ক:
মানবপাচারের েেত্র জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে সরকার। কারণ মানবপাচারকারীরদের প্ররোচনায় দেশের সহজ-সরল মানুষ বিদেশ গিয়ে নানা হয়রানির মুখে পড়ছে। একই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হ”েছ বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজও। কিš’ আইন-শ”ড়খলা বাহিনী মানবপাচার মামলায় রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না। কারণ এখন পর্যন্ত দায়ের হওয়া মানবপাচার মামলার অধিকাংশ আসামিই গ্রামের বা উপজেলা পর্যায়ের দালাল। তার উপরের ধাপের মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িতদের মামলার আসামি করা যা”েছ না। ফলে তারা অধরাই থেকে যা”েছ। এদেশ থেকে মূলত কাটআউট পদ্ধতিতে মানবপাচার চলছে। সেজন্যই মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ রাঘববোয়ালই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যা”েছ। তবে মাঝেমধ্যে দু’একজন গ্রেফতার হলেও অকাট্য প্রমাণাদির অভাবে তাদের অধিকাংশেরই সাজা নিশ্চিত করা যা”েছ না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের গ্রাম থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবপাচারকারীরা জাল বিস্তার করে রেখেছে। ওই চক্রের সদস্যরা এক থেকে বড়জোর দুই ধাপ উপরের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ রাখে। বাকিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। মানবপাচারের অধিকাংশ মামলাই তদন্ত করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। তার বাইরে ডিবি পুলিশ ও থানা পুলিশও কিছু কিছু মামলা তদন্ত করছে। সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই মানবপাচারের মামলা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হ”েছ। কক্সবাজারের থানাগুলোতে দেশের সবচেয়ে বেশি মানবপাচারের মামলা দায়ের হয়েছে। দ্বিতীয় অব¯’ানে রয়েছে উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন জেলার থানা। শুধুমাত্র সিআইডি পুলিশই সারাদেশের প্রায় এক হাজার মানবপাচার মামলার তদন্ত করেছে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশ পাঠানোর নামে সহজ-সরল মানুষদের আকাশ, ¯’ল ও জলপথে পাচার করা হ”েছ। সরকার, আইনশৃড়খলা রাকারী বাহিনী, কূটনৈতিক সম্পর্কসহ নানা দিক থেকে যোগাযোগ করে পাচারকৃতদের ফেরত আনা অব্যাহত রেখেছে। তবে প্রতিবছর দেশ থেকে কত মানুষকে বিদেশ পাঠানোর নামে পাচার করা হ”েছ তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। মানবপাচারে রাঘববোয়ালরা জড়িত। তবে তাদের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণাদি হাজির বা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। কারণ প্রথমত তাদের মামলায় আসামি করা হয় না। যেজন্য তাদের আইনের আওতায় আনা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়।
সূত্র আরো জানায়, অনেকটা জঙ্গীদের মতো কাটআউট পদ্ধতিতে মানবপাচারের ঘটনাগুলো ঘটছে। বহু ধাপে মানবপাচারের ঘটনা ঘটার কারণে তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার কারণ সর্বশেষ মানবপাচারের সঙ্গে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের নাগাল পাওয়া যায় না। তবে পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা দেশে ফিরেই গ্রামের বা উপজেলা পর্যায়ের যে দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে বিদেশ গিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। কারণ আর্থিক লেনদেনও ওসব দালালের মাধ্যমেই হয়। ওসব দালাল একবারে গ্রাম পর্যায়ে কাজ করে। আর গ্রামের দালালদের নিয়ন্ত্রণ করতে উপজেলা পর্যায়ে চক্র থাকে। আবার উপজেলা পর্যায়ের দালালদের নিয়ন্ত্রণ করে জেলা পর্যায়ের দালালরা। গ্রামের দালালরা বড়জোর জেলা পর্যায়ের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। এর বাইরে তারা আর পারে না। জেলার পর্যায়ের দালালরা ঢাকার দালাল বা রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। আর ঢাকার দালালদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও বিভিন্ন দেশের চক্রের যোগাযোগ থাকে। মূলত মানবপাচার একটি বিশাল চেইনের (শিকল) মতো। ঢাকা থেকে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মানবপাচার হয়ে থাকে। এজেন্সিগুলোর সঙ্গে দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র, বিমানবন্দর, সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ¯’ দূতাবাস, ইমিগ্রেশন বিভাগ, সমুদ্রবন্দরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগ রয়েছে। মূলত তারাই মানুষদের বিদেশে পাঠানোর নাম করে পাচার করে দেয়। আর এমন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের দালালদের সঙ্গে দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র বা বিক্রুটিং এজেন্সির সরাসরি যোগাযোগ থাকে না। পাচারের শিকার হওয়াদের সঙ্গে মূল পাচারকারীদের কোন সময়ই যোগাযোগ বা দেখা সাাত হয় না। অত্যন্ত সুকৌশলে ধাপে ধাপে মানবপাচারের কাজটি হয়। পাচারকারীরা নিজেদের আড়ালে রাখতে কমিশনের ভিত্তিতে চক্র তৈরি করে। গ্রামে যে ব্যক্তির কাছ থেকে মালয়েশিয়ার যাওয়ার জন্য ৩/৪ লাখ টাকা নেয়া হয়, মূল রিক্রুটিং এজেন্সি তা থেকে হয়তো অর্ধেক টাকা পায়। বাকি টাকা বিভিন্ন ধাপে দালালরা পেয়ে থাকে।
এদিকে মামলার তদন্তে প্রান্তিক পর্যায়ের দালাল, থানা পর্যায়ের দালাল, জেলা পর্যায়ের দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সি সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায়। কিš’ মামলায় রিক্রুটিং এজেন্সিকে আসামি না করায় এবং তাদের বিরুদ্ধে পাচারের অকাট্য প্রমাণাদি না থাকায় তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। আবার অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যবসা করে থাকে। সারাদেশে প্রকৃতপে মানবপাচারের কতগুলো সিন্ডিকেট রয়েছে তারও সঠিক কোন পরিসংখ্যান কারোর জানা নেই।
অন্যদিকে পাচারের পর উদ্ধারকৃতদের ইরান, থাইল্যান্ড, লিবিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আনা হ”েছ। ইতিমধ্যে ফেরত আনাদের মধ্যে প্রায় ১৫শ’ জনকে অবৈধভাবে প্রবেশের দায়ে গ্রেফতার করেছিল থাইল্যান্ড পুলিশ। পরে তাদের পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একের পর এক গণকবর আবিষ্কৃত হওয়া ও লিবিয়ায় গুলি চালিয়ে ৪৪ বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনা আবারো মানবপাচারের ঘটনাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। শুধুমাত্র ২০১৪ সালেই সিআইডির তরফ থেকেই সংঘবদ্ধ অপরাধ সংক্রান্ত ৩১শ’ মামলার তদন্ত করা হয়। যার মধ্যে ২ হাজারেরও বেশি ছিল মানবপাচারের মামলা। প্রতি বছর গড়ে সারাদেশে এক হাজারের বেশি মানবপাচারের মামলা হয়। মানবপাচারের মামলায় গত ৬ বছরে ২০ হাজারের বেশি জনকে আসামি করে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। চার্জশীটভুক্ত আসামির অধিকাংশই দালাল। আর আসামির অধিকাংশই দেশে বা বিদেশে পলাতক। এমন পরি¯ি’তিতে পুলিশ মহাপরিদর্শক পুলিশের প্রতিটি ইউনিট প্রধানকে মানবপাচার সংক্রান্ত মামলা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে লিখিত চিঠি দিয়েছেন। পুলিশের তরফ থেকে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা জানান, লিবিয়ায় পাচারের পর গুলি করে বাংলাদেশী হত্যার ঘটনায় সিআইডি ১৫টি মামলা করেছে। সব মিলিয়ে সিআইডি সদর দফতর বিপুলসংখ্যক মানবপাচারের মামলা তদন্ত করছে। সারাদেশেই সিআইডির টিম, থানা পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ মানবপাচার মামলার তদন্ত করছে। সিআইডি গত বছর ও চলতি বছর পাচার হওয়াদের মধ্যে অনেককেই ফেরত আনতে সম হয়েছে। যার পরিমাণ অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি।