কমতির দিকে সরকারিভাবে খাদ্যের মজুদের পরিমাণ

0
194

টাইমস ডেস্ক:
সরকারিভাবে দেশে খাদ্যের মজুদের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে খাদ্যের মজুদের পরিমাণ নেমে এসেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায়ও নিচে এসেছে। চলতি বছর মহামারীর কারণে অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়েছে। ফলে সরকারি ত্রাণ সহযোগিতার ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়ে গেছে। সামনের দিনগুলোয় করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় সংক্রমণের ঢেউ বয়ে গেলে রড অনিশ্চয়তা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে তা মোকাবেলায় সরকারি খাদ্যগুদামগুলোয় এখনই মজুদ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়া জরুরি। অন্যথায় দেশজুড়ে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিজ্ঞানীরা আসন্ন শীতে করোনা মহামারীর আরেক দফা ঢেউ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। ইতিমধ্যে ইউরোপের ওপর দিয়ে দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ ঢেউ বয়ে চলেছে। বাংলাদেশেও আসন্ন শীতে আরেকটি বড় সংক্রমণ ঢেউ মোকাবেলা করার আশঙ্কা করছে সরকার। বিশ্বের অন্যান্য দেশও এ আশঙ্কায় রয়েছে। মহামারীসৃষ্ট অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্ততি হিসেবে ইতিমধ্যে ওসব দেশ এখনই খাদ্যের মজুদ বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু এদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে বিপরীত চিত্র। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী এখন কমতির দিকে দেশে খাদ্যের সরকারি মজুদ। বর্তমানে এ মজুদের পরিমাণ নেমে এসেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় নিচে নেমে এসেছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুদের পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ টন। তার মধ্যে চাল রয়েছে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬০ টন ও গম ৩ লাখ ১১ হাজার ৯৪০ টন। অথচ গত বছরের একই সময়ে দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুদ ছিল ১৭ লাখ ২০ হাজার ৩২০ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৩০ শতাংশেরও বেশি খাদ্যশস্যের মজুদ হ্রাস পেয়েছে। আর এক মাস আগের মজুদ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দেখা যায় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ হ্রাস পাচ্ছে। চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি গুদামগুলোয় মোট খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ১৯ হাজার টন। ওই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ হ্রাস পেয়েছে ১৬ শতাংশের কাছাকাছি। তাছাড়া এবার সরকারিভাবে পরিচালিত স্থানীয়ভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানের ফলাফল খুব একটা সন্তোষজনক নয়। আমন মৌসুমে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে সংগ্রহের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকলেও বোরো মৌসুমের ক্ষেত্রে বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। সরকারি মজুদ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা থেকে চলতি বছর বোরো মৌসুমে মোট ৮ লাখ টন ধান সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ টন। তাছাড়া চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ১১ লাখ টন। কিন্তু তার বিপরীতে সিদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে যথাক্রমে ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯০ ও ৯৯ হাজার ১২৩ টন। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা সরকারকে দ্রুত ১০-১৫ লাখ টন চাল আমদানি করে রাখা জরুরি বলে বলে মনে করছে। কারণ ইতিমধ্যে আগাম বিপদের কথা ভেবে বিভিন্ন দেশ খাদ্য আমদানি করা শুরু করে দিয়েছে। গমের ক্ষেত্রে এদেশ এমনিতেই অনেকটা আমদানিনির্ভর। তবে সঙ্কটদের কথা বিবেচনায় নিয়ে এখনই চাল আমদানি করা প্রয়োজন। সেজন্য সরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে শুল্ক সুবিধা দিয়ে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যা এখন বিশ্বের অন্য অনেক দেশই করছে।
সূত্র আরো জানায়, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা থেকে প্রধানমন্ত্রীও মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে এসেছেন। তবে এ বছর খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রয়োজনমাফিক না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সাম্প্রতিক এক প্রাক্কলনে বলা হয়, সদ্যসমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। আর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মতে চলতি বছর চালের উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ সম্ভাবনা নিয়েও বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা দ্রুত খাদ্য আমদানি বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। কারণ সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশে শস্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে শস্য উৎপাদন সম্পর্কে যেসব তথ্য দেয়া হচ্ছে সেগুলো নিয়েও সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, খাদ্যশস্যের মজুদ কোনোভাবেই দুর্বল করা যাবে না। প্রয়োজনে এখনই আমদানির উদ্যোগ নিয়ে মজুদ বাড়াতে হবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে খাদ্যপণ্যের আমদানি চাহিদা বাড়ার কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্যের মূল্যসূচকও এখন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী সেপ্টেম্বরেও বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য সূচক টানা চতুর্থ মাসের মতো ঊর্ধ্বমুখিতায় ছিল। ওই সময় বৈশ্বিক গড় খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ২ শতাংশেরও বেশি। আর গত সপ্তাহেই মহামারীর কারণে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংকট আরো প্রকট হয়ে ওঠার হুঁশিয়ারি দিয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে খাদ্যনিরাপত্তা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি জনসাধারণের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়তে পারে। কারণ মহামারীর প্রাদুর্ভাব বিশ্বের দেশে দেশে অর্থনীতিতে ধস নামানোর পাশাপাশি কর্মহীনতাও বাড়িয়েছে। বাংলাদেশেও একই পরিস্থিতি। মহামারী দেখা দেয়ার পর থেকেই অর্থনীতির স্থবিরতায় প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের আয়ও হ্রাস পেয়েছে। বিবিএসের পরিসংখ্যান মতে. করোনার টওথম ৫ মাসে দেশে পরিবারপিছু মাসিক আয় হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৪ হাজার টাকা। দেশে এখন এমনিতেই আলুসহ কয়েকটি শস্যের মূল্যে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় খাদ্যশস্যের সামান্যতম ঘাটতি দেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংকটকে আরো প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে মহামারীসৃষ্ট অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় বিশ্বের অনেক দেশেই এখন খাদ্যের উৎপাদন ও মজুদ বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে গমের শীর্ষ আমদানিকারক মিসর এপ্রিলের পর থেকেই পণ্যটির ৫০ শতাংশেরও বেশি হারে আমদানি বাড়িয়েছে। খাদ্যশস্যের মজুদ রেকর্ড সর্বোচ্চ পরিমাণে নিয়ে এসেছে জর্ডান। তাছাড়া খাদ্যশস্যের অন্যতম শীর্ষ ভোক্তাদেশ চীনও খাদ্যদ্রব্য আমদানি বাড়িয়ে চলেছে। আমদানি বাড়াচ্ছে পাকিস্তান, মরক্কোসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ। তার মধ্যে কোনো কোনো দেশ খাদ্যশস্যের মজুদ বাড়াতে ইতিমধ্যে আগামী কয়েক মাসের জন্য আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, মহামারীর শুরুতেই দেশে দেশে বন্দরগুলোর পণ্য খালাস ও বোঝাই কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটার পাশাপাশি বিশ্ববাণিজ্যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। একই সঙ্গে মহামারীর প্রাদুর্ভাব স্থানীয় সরবরাহ কার্যক্রমকেও স্থবির করে দেয়। তাছাড়া শুরুতেই কয়েকটি দেশে ভোক্তাদের অতিরিক্ত মজুদপ্রবণতা বাজারে খাদ্যপণ্যের মারাত্মক সরবরাহ ঘাটতি তৈরি করে। দেশে দেশে মহামারীর মতো এ অতিরিক্ত প্রবণতাও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ভোক্তাদের মধ্যে সংক্রমিত হতে থাকে। ফলে দেশগুলো আমদানি বাড়ানোর তাগিদে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ক্রয়ের জন্য একের পর এক দরপত্র ছাড়তে থাকে। মূলত মহামারীসৃষ্ট অনিশ্চয়তাকে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্য আমদানি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ভবিষ্যতে আবারো সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটানোর আশঙ্কা থেকেই অনেক দেশ এখন খাদ্য আমদানি বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। তার মধ্যে প্রকৃতপক্ষেই হাতে গোনা কয়েকটি দেশের খাদ্যের কৌশলগত মজুদ বাড়ানোর উদ্দেশ্য রয়েছে। বাকি দেশগুলোর আমদানি বাড়ানোর পেছনে যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, স্থানীয় সরবরাহ পরিস্থিতি ও স্থানীয় বাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোও রয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণেও কোনো কোনো দেশ আমদানি বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।
দেশের খাদ্যপণ্যের সার্বিক বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, গত বছর এ সময়ে খাদ্যশস্যের মজুদ এখনকার চেয়ে ৫ লাখ টন বেশি ছিল। খাদ্যশস্যের মজুদ বেশি হলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এখন মজুদ যে পর্যায়ে আছে তা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। যদি এর চেয়ে কম হতো, তাহলে তা দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে আমন ধান চলে আসবে। ডিসেম্বর থেকে জোরেশোরে ধান কেনা শুরু করা হবে। তাছাড়া দুই লাখ টন আমদানির গম আসবে। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির জন্যও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ফলে খাদ্যের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। যদি হঠাৎ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলে না আসে, তাহলে দেশের খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি স্বাভাবিকই রয়েছে। তাছাড়াও খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে অনুমতি নেয়া আছে। যদি কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি শুনি হয়ে যায় তাহলে সরকারের সে প্রস্ততিও রয়েছে।