কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল এন্ড কলেজে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে সীমাহীন অভিযোগ

0
372

কপিলমুনি প্রতিনিধি:
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ’র বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের পর এবার স্বজনপ্রীতি,হটকারিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে।
শুরুতে নানা বিতর্কের পর শেষ সময়ে নতুন বিতর্ক বিদ্যাপীঠে তার দীর্ঘ দিনের ক্যারিয়ারে কালিমায় নতুন পালক যোগ করেছে। (ইনডেক্স নং- ২০৮৯৭৬)। চাকুরীর আগে ছাত্র জীবনে ¯œাতক থেকে ¯œাতকোত্তর। দু’বছরের এই শিক্ষা জীবন পেরোতে যার সময় লেগেছিল ১৫ বছর। সময়টা ১৯৭৭-৮৫ থেকে ৯২। পুরোটা সময় জমকালো কাহিনীতে ঠাসা।
সম্প্রতি এক শিক্ষক প্রতিনিধির সাথে সাধারণ এক শিক্ষকের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় কৌশলী প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এক সময়কার জেলা ফাস্ট ও প্রসিদ্ধ কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরটি অত্যাধুনিক কপিলমুনির রুপকার রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে হরেকৃষ্ণ দাশের যোগদান নিয়েও ছিল নানা বিতর্ক। শুরু থেকে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়েনি তার। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছরের কর্ম জীবনে এই শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ডে অপসারনের দাবিতে ইতোপূর্বে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ গণস্বাক্ষর করে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছিল। তার নানা অনিয়মের খবর বিভিন্ন সময় খবরের শিরোনাম হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক এক ফোনালাপ শেষ সময়ে তার সমালোচনায় যেন আগুণে ঘি ঠালার অবস্থা হয়েছে। নতুন করে নানা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে ঐ রেকর্ডে। ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রানালয়ের (নিরীক্ষা অসিঃ) যুগ্ম পরিচালক টুটুল কুমার নাগ বিদ্যালয় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা সংক্রান্ত কর্মশালা পরিচালনা করেন। বর্তমান প্রধান শিক্ষক তার এবং কয়েকজন শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যক্তিগত ত্রুটিপূর্ণ কাগজ পত্রের বিষয়টি ধামা চামা দিতে এক এমপিও পরিমান (৪,৮৯,৩৪৪ টাকা) প্রায় ৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে বলে দাবি করেন।

এব্যাপারে শিক্ষক প্রতিনিধি কার্ত্তিক চন্দ্র সরকার বলেন, প্রথম থেকেই অডিটের ব্যাপারে তাদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। অনেক বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে ধোঁয়াশাও তৈরী হয়েছিল। এসব নানা কারণে তিনি ও তার একজন সহকর্মীকে সাথে নিয়ে অডিটের পূর্বে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ডিসি সাহেবের সাথে দেখা করেছিলেন। তিনি অডিটে আসা দায়িত্বশীল কর্তা-ব্যক্তিকে তার (ডিসি সাহেবের) অফিসে ঘুরে যাওয়ার কথা বলেন। ডিসি সাহেবের পরামর্শ মোতাবেক তারা অডিটে কোন রকম টাকা দিতে প্রধান শিক্ষককে আপত্তি জানায়। তবে প্রথমে এক এমপিওর টাকা দাবি করলেও পরে ২ লক্ষ টাকার নিচে হাতে দিলে হবেনা বলেও জানান তিনি। পরবর্তীতে লক্ষাধিক টাকা শিক্ষকদের কাছ থেকে তুলে রাখা হয়েছে স্বীকার করে বলেন, উনি (প্রধান শিক্ষক) ব্যক্তিগত অনেক নয়-ছয় করেন। বলা যেতে পারে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ৮০ থেকে ৯০% সত্য। আমি একজন সদস্য হিসেবে মনে করি প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয়সহ সব কিছুর স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। এর আগে যারা ছিলেন তারা সবাই উনার কর্মকান্ডকে সমর্থন করেছেন। এ নিয়ে শিক্ষদের মধ্যে চরম অসস্তোষ ছিলো। আমি চাই উনার কর্মকান্ড অন্ধকারে না থেকে আলোর মধ্যে আসুক।

অপর একটি সুত্রের দাবি, নিরীক্ষা চলাকালীন সময়ে পরিচালনা পরিষদের সভাপতির সাথে শিক্ষা পরিদর্শক টুটুল কুমার নাগের মুঠো ফোনে সৌজন্যমুলক আলাপ হয়। এ ঘটনার পর প্রধান শিক্ষকের এক এমপিও অর্থ দাবির আওয়াজটা সংকুচিত হয়। যার ধারাবাহিকতায় ২ জন শিক্ষক ও কর্মচারী বাদে বাকি ২২ জন শিক্ষক ৫/৬ হাজার টাকা হারে ১ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে উত্তোলন করে। বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের একাধিক বর্তমান ও সাবেক সদস্য, অভিভাবক ও স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ একজন অযোগ্য, উপঢৌকনবাজ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্টকারী। তার বিরুদ্ধে বিধি বহিভুত প্রজেক্ট বাস্তবায়ন, আবাসিক কোয়াটার নির্মানে অতিরিক্ত ব্যয়, টেন্ডার ছাড়ায় বিভিন্ন মেয়াদে কোটি কোটি টাকা বিপনী বিতান নির্মান, গেস্ট হাউজ সহ ইচ্ছামাফিক অপরিকল্পিত সংস্কার কাজের নামে অর্থ আত্মসাৎ, হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর না করা, মুভমেন্ট রেজিষ্টার না মেনে পারিবারিক ও ঘের ব্যবসায় স্কুল চলাকালীন সময়ে সময় ব্যয়, ভাউচারে কাউন্টারে স্বাক্ষর না করা সহ নানা অনিয়ম করেছে। স্থানীয়দের দাবি, বিদ্যালয় চত্ত্বর জুড়ে গড়ে উঠা ৮৫ টি দোকান ঘরের আয়ের হিসাব, দোকান ঘরের মালিকানা হস্তান্তরের আইনগত দিক খতিয়ে দেখা জরুরী। প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ নিয়োগকাল থেকে বিদ্যালয়ের কোয়াটারের থাকেন। এদিকে তিনি সরকারি তহবিল থেকে নিয়মিত বাড়িভাড়া উত্তোলন করেন। এমপিও প্রাপ্তি থেকে খতিয়ে দেখলে সত্যতা মিলবে। প্রধান শিক্ষক নিজে ১৫ বছরে ১টিও ক্লাস নেননি এমনকি ক্লাসের বাইরে শিক্ষকরা টিউশনিতে ব্যস্ত থাকলেও তিনি কোন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে স্বজন প্রীতির অভিযোগ করেছেন অনেকে। এদিকে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল এন্ড কলেজ এমপিও (কলেজ পর্যায়) করাতে প্রধান শিক্ষকের আস্থাভাজন টাঙ্গাইলের ফারুকের (ওরফে পিয়ন ফারুক) দাবিকৃত ৫ লক্ষ টাকার মধ্যে ২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা স্থানীয় ব্যাংকের মাধ্যমে তার একাউন্টে কয়েক দফায় পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ঘোষিত এমপিও এর তালিকায় স্কুল এন্ড কলেজ পর্যায়ে এই প্রতিষ্ঠানের নাম না থাকায় ক্ষোভে নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক শিক্ষক কর্মচারী সাংবাদিককে এ তথ্য জানিয়েছেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির নেতা হিসেবে সরকারী নীতিমালার বাইরে নিন্মমানের গাইড বই বিক্রয়ে সুযোগ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছে এমন অভিযোগ রয়েছে। এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ এর ১১.৬ ধারার নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে বয়স ৬০ (ষাট) বছর পূর্ণ হবার পরও শিক্ষক পুণঃ নিয়োগ দিয়ে বিধি ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসকের পরামর্শ এড়িয়ে শঠতার আশ্রয় নিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভায় সদস্যদের উপস্থিতির সূচক স্বাক্ষরকে সিদ্ধান্ত মূলক স্বাক্ষর হিসেবে চালিয়ে দিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অভিভাবক সদস্য কিনু পাল প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তার অনৈতিক কোন কর্মকান্ডের দায় আমাদের নয়। আমি প্রধান শিক্ষকের অবসরে যাওয়ার পূর্বেই বিদ্যালয়ের সকল আয় ব্যয় সহ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ও সম্পদের যাবতীয় কাগজপত্র সরকারি ভাবে নিরপেক্ষ নিরীক্ষনের দাবি জানাচ্ছি। দাবি উঠেছে, বিদ্যালয় চত্ত্বরে এ যাবতকাল তৈরী সকল বিপনীর বর্তমান মালিক কারা, কাদের নামে প্রথম বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, তার তালিকা প্রস্তুত করা, মালিকানা হস্তান্তরের আইনগত বৈধতা খতিয়ে দেখা এবং এগুলোর বৈষম্য মুক্ত ভাবে আয়ের হিসাব নিরীক্ষনের জন্য নিরপক্ষ সরকারী ভাবে তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহন করা। প্রধান শিক্ষক যোগদানের পর থেকে বিদ্যামন্দিরের সকল আয় ও ব্যয় বিশেষ করে আপ্যায়ন খাতের ব্যয় বাৎসারিক সংস্কার ব্যয় বরাদ্দ সরকারি ভাবে নিরীক্ষা করা। এছাড়া প্রধান শিক্ষকের নিজ হটকরী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনৈক অভিভাবক সদস্য শেখ আব্দুস ওয়াহিদ বাদী হয়ে হাইকোটের রীট পিটিশন (পিটিশন নং-৩২৪/২০১৪) টি মোকাবেলায় স্কুলের প্রায় ৬ লক্ষ টাকা খরচের বৈধতা যাচায় করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। প্রধান শিক্ষক হরেকৃষ্ণ দাশ বলেন, আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। আমি কিছু বলতে চাই না । মিনিষ্ট্রি অডিট প্রসঙ্গে বলেন, টাকা দেওয়াটা এ দেশে নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমি নয় শিক্ষা পরিদর্শক টুটুল নাগ নিজে আমার শিক্ষক প্রতিনিধির সামনে এক এমপিও টাকা দাবি করেন। আমার নিয়োগপত্রে স্কুলের বাসভবন ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সরকারি বাসাভাড়া গ্রহণ করতে বাধা নেই। তিনি বাড়ি ভাড়া বাবদ সরকারি বরাদ্দ গ্রহণের কথা স্বীকার করেন।