কপিলমুনিতে ১৯৭১’র অরক্ষিত বধ্যভূূমিতে ৩৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ’র নির্মাণ

0
573

শেখ নাদীর শাহ্: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কপিলমুনি অঞ্চলের নীরিহ মুক্তিকামীদের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ তীরের বহুলালোচিত ফুলতলা বধ্যভূমিতে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ। দীর্ঘ দিনের অরক্ষিত ময়লা স্তুপের উপর স্বাধীনতার ৪৯ বছরে অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভটি নির্মিত হয়েছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীণ খুলনার অন্যতম প্রধান রাজাকার ঘাঁটি ছিল কপিলমুনি। আধুনিক কপিলমুনির প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য দ্বিতল বিশিষ্ট বাড়িটি দখল করে স্বাধিনতা বিরোধীরা সেখানে গড়ে তোলে এ রাজাকার ঘাঁটি। স্বার্বক্ষণিক দু’শতাধিক সশস্ত্র রাজাকার ঘাঁটিটির তত্ত্বাবধানে থেকে কপিলমুনিসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষের প্রতি চরম অত্যাচার করত। সেখান থেকে তারা এমন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করতেন না। নারী ধর্ষণ থেকে শুরু করে,লুটতরাজি ও হত্যা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এছাড়া ঘাঁটির মধ্যেও ছিল অত্যাচার সেল। যেখানে কারো মৃত্যু হলে সেখান থেকে সুড়ঙ্গ পথে লাশ বয়ে এনে ফেলা হত কপোতাক্ষে।
১৯৭১ ’র ৯ ডিসেম্বর ৩ দিনের সম্মুখ যুদ্ধ শেষে রাজাকাররা আত্নসমর্পণ করলে জনতার রায়ে সকলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যুদ্ধকালীণ সময়ে জনতার আদালতে রায় কার্যকরের ঘটনা সম্ভবত এটিই প্রথম। এছাড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর বাংলাদেশে এটি দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়েছে। ৯ ডিসেম্বর তৃতীয় দফার যুদ্ধে ১৫৫ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্নসমর্পণের পর ঘাঁটি থেকে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন কাগজপত্রের সাথে উদ্ধার হয় তাদের হাতে শহীদ ১৬০১ জন শহীদের তালিকা। আরো সহস্রাধিক নীরিহ মুক্তিকামীর তালিকা উদ্ধার হয়। যারা তাদের পরবর্তী টার্গেটে ছিলেন। রাজাকাররা নীরিহ মুক্তিকামীদের ধরে এনে কপিলমুনির কপোতাক্ষ তীরবর্তী ফুলতলা নিয়ে গুলী করে হত্যা শেষে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিতেন। অথচ স্বাধীনতার প্রায় ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হচ্ছে এখন।
ইতোমধ্যে নবনির্মিত স্তম্ভ’র শৈল্পিক নিদর্শন নজর কেড়েছে এলাকাবাসীকে। স্টীলের এস এস পাইপের তৈরী সুরম্য প্রাচীর বেষ্ঠিত গৌরবজ্জ্বল ঐতিহাসিক বধ্যভূমি চত্ত্বর সাজানো হয়েছে নানা স্বজ্জায়। সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে শিশুদের নিয়ে সময় কাটানোর জন্য বসানো হয়েছে আকর্ষণীয় দোলনা ও সড়ক পাস। দক্ষিণ পাশ জুড়ে স্মৃতিস্তম্ভের দন্ডায়মান স্মারক চিহ্ন যে কারোর নজর কাড়ার পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দেবে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে। স্মারক চিহ্নের সমতল অংশে ডিজিটাল ইট পাথরের সমন্বয়ে বসানো টাইলস বাড়তি সৌন্দর্য বর্ধন করেছে। দর্শণার্থীদের জন্য রয়েছে বাথ ব্যবস্থা। দর্শণার্থীরা স্তম্ভে এসে দিনের প্রকৃতিতে যুদ্ধের ইতিহাস আহরণের পাশাপাশি পাশ দিয়ে বয়ে চলা প্রবহমান কপোতাক্ষের সৌন্দর্য ও রাতের আলোক ঝলমল বৈদ্যুতিক বাতি যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। ইতোমধ্যে এর পাশ দিয়ে বয়ে চলা বাইপাস সড়কের পথচারী থেকে শুরু করে বাইরের পর্যটকদের নজর কেড়েছে কপিলমুনির মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ।
কপিলমুনি মুুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধা,মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল ধর্ম,বর্ণের মানুষের বিশ্বাস,কপিলমুনির মুক্তিযুদ্ধ,যুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় স্মৃতি স্তম্ভটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘদিন পরে হলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন তারা।
তথ্যানুসন্ধান ও সরেজমিনে প্রতিবেদনকালে দেখাযায়, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির কপোতাক্ষের তীর ঘেঁষে সাবেক ফুলতলা বধ্যভূমির নির্দ্ধারিত স্থানে বর্তমান সরকার ৩৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছে দৃষ্টিনন্দন স্তম্ভটি। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময় সরকারের পট পরিবর্তনে কয়েকযুগ অতিবাহিত হলেও বধ্যভূমি সংরক্ষণে এগিয়ে আসেনি কেউ।
তবে ২০১৩ সালের প্রথম দিকে সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাড. সোহরাব আলী সানা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ রশীদুজ্জামান মোড়ল মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমি নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু অর্থাভাবে মাঝ পথে থমকে যায় এর নির্মাণ কাজ। এরপর থেকে স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মহান বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে অরক্ষিত নির্মাণাধীন স্মৃতিস্তম্ভে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে আসছে।
সর্বশেষ বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বধ্যভূমির নির্দ্ধারিত স্থানে স্মৃতিস্তম্ভের কাজ শুরু করে। যা ২০২০ সালের জানুয়ারীতে শেষ হয়েছে।