এবার বত্রিশ, সাংবাদিকতার আরেক বিপদ

0
990

কৌশিক দে : বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদের প্রথম দিকে ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’ পাশ হলে আমার মতো অনেকেই খুশী হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের অজুহাতে সরকারি-বেসরকারি তথ্য প্রদান না করার যে ধারা শুরু হয়েছিল, তা এ আইনের অধীনে অনেকটাই বন্ধ হবে বলে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। এ নিয়ে যত বির্তক থাক না কেন বাস্তব অর্থে ‘তথ্য অধিকার আইন’ টি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে অনেক তথ্যই ধীরে হলেও বের করা সম্ভব ছিল, যা সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের আশাবাদী করে তুলতো। তবে কথায় আছে ‘ফকিরে সুখ বেশী দিন থাকে না’। আমাদের অবস্থাও তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে তথ্য অধিকার আইনের বিপরীতে সদ্য বিলুপ্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা আর নতুন আসা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-খসড়ার ৩২ ধারা নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। বিশেষ করে সাংবাদিক, লেখক, গবেষকদের জন্য নতুন এক আতংক হয়ে উঠতে পারে নতুন খসড়া আইনের ৩২ধারা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি আইনের ছাত্র নয়, আইন নিয়েও খুব বেশী জানাশোনাও নেই। তবে পারিপার্শ্বিক আলোচনা-সমলোচনা, প্রয়োজনে ঠেকে কিছু বুঝতে যাওয়া বিষয় এই আইন। সোমবার মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন হওয়ায় আলোচনার ঝড় উঠছে। সেইসব আলোচনা থেকে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, এ আইন অবাধ তথ্য প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষ করে আইনটির ৩২ ধারার মাধ্যমে ‘অনুসন্ধানী’ সাংবাদিকতার পথ অনেকটাই বন্ধ হবে। মূলত: সাংবাদিকদের প্রেসরিলিজ, প্রেসনোট নির্ভর সাংবাদিকতার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হবে। এতে দুর্র্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ প্রদান, অনৈতিক কর্মকান্ডের মতো বিষয় তুলে আনা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা অনেক অজানা বিষয় সাধারণ মানুষ আর দেখতে পাবেন বলে মনে হয়না।
সংবাদ পত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্তে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হলেও নতুন আদলে ধারাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন কয়েকটি ধারার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি আরো কঠোর রূপ ধারণ করেছে। আইনটিতে ১৪টি ধারায় উল্লেখ করা বিভিন্ন অপরাধকে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার গোপনীয় বা অতিগোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কেউ ধারণ করলে তা হবে ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির শামিল। শাস্তি প্রথমবার অপরাধে ১৪ বছরের কারাদ- বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা, দ্বিতীয়বার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদ- বা এক কোটি টাকা জরিমানা। এ অপরাধে গ্রেপ্তার হলে জামিনও মিলবে না। (সূত্র: দৈনিক কালের কণ্ঠ, তারিখ ৩০/০১/১৮)।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৩২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতিগোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করে তাহলে তা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির পর্যায়ে পড়বে। প্রথম দফা এ অপরাধ করলে ১৪ বছরের কারাদ- বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- প্রয়োগ করা যাবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে যাবজ্জীবন কারাদ- বা এক কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দেওয়া যাবে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারার অপরাধকে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪।
আমি আগেই বলেছি, আমি আইন বিশেষজ্ঞ নই। তাই এই আলোচনায় অন্যসব ধারা নিয়ে আলোচনা না করে সাংবাদিকদের আলোচনায় উঠে আসা ৩২ ধারায়ই সীমাবদ্ধতায় থাকতে চাই। এই ধারায় ‘ কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতিগোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করে তাহলে তা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির পর্যায়ে পড়বে।’ লাইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনটি পাশ হলে কোন সংবাদকর্মী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সেই দপ্তরে অবাধ প্রবেশ থেকে শুরু করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারবেন না। আর যদি তিনি (সংবাদকর্মী) সেই কাজটি করেও ফেলেন, সেটি প্রকাশ হলে তিনি ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ অভিযোগে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত হয়ে যেতে পারেন। ফলে এই ঝুঁকিটি নেয়া সাংবাদিকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেননা যারা দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুষ গ্রহণের মতো কাজ করবে, তারা কোনভাবেই সেটি প্রকাশ্যে করবেন না। পৃথিবীতে কোন মানুষই নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনার মতো ঝুঁকি নেবে না। ফলে এই এক ধারায়ই ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার’র কবর রচনা হচ্ছে; এটা বলা যায়। অবশ্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘এটা অহেতুক ভীতি।’ তিনি বলেন, ‘গুপ্তচরবৃত্তি একটি অপরাধ, গুপ্তচরবৃত্তি তো আগের আইনে অপরাধ ছিল। এ আইনের মধ্যে যেটা করেছি সেটা হচ্ছে, ওই যে কম্পিউটার সিস্টেম, ইনফরমেশন টেকনোলজির যে সিস্টেম ওই সিস্টেমের মাধ্যমে যদি কেউ গুপ্তচরবৃত্তি করে সেটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক আছে বলে তো আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় এটা অহেতুক ভীতি। সমালোচনার ক্ষেত্রে সমালোচনা করা হচ্ছে।’
আনিসুল হক বলেন, ‘আমি আরেকবার অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের নেত্রী। জনগণ মানে সাংবাদিকতা। তিনি অহেতুক ও অযথা কেউ হয়রানি হোক সেটা চান না। তাই কোনো আইনের মধ্যে এমন ব্যবস্থা থাক সেটা তিনি চান না। সেই কারণে স্পষ্ট করে এ ধারাগুলো দেয়া হয়েছে। যাতে অস্পষ্টতা দূর হয়। এখন এখানে (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) যেভাবে অপরাধের ধারাগুলো সংজ্ঞায়িত হয়েছে এবং অপরাধটা কী সেটা পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে তাতে আপনাদের (সাংবাদিক) বাক-স্বাধীনতা একটু হলেও ক্ষুণœ করা হয়নি।’
আমরা মাননীয় আইনমন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হতে চাই। তারপরও বলবো, ৫৭ ধারা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখের নয়। এখনও খুলনায় ওই আইনে একটি মামলায় খুলনার সিনিয়র সাংবাদিক মোতাহার রহমান বাবু ও তাঁর সহকর্মী সোহাগ দেওয়ান এক প্রকার ‘দৌড়ের পর’ আছেন। শুনেছি কেউ কেউ তাদের হুমকিও দিচ্ছেন। আমরা খুলনার সাংবাদিকরা এ নিয়ে উদ্বীগ্নও বটে। আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সাংবাদিক বান্ধব। তিনিই প্রথম সাংবাদিকদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছেন। সেখান থেকে নিয়মিত সাংবাদিকদের সহায়তাও দিচ্ছেন। সর্বশেষ সাংবাদিক নবম ওয়েজ বোর্ডের ঘোষণা দিয়েছেন। তাই, তাঁর কাছ থেকে সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে এমন আইন হবে বলে বিশ্বাস করতে চাইনা। আমরা চাই, মানুষের বাক স্বাধীনতার জয় হোক, জয় হোক উম্মুক্ত তথ্য প্রবাহের।

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ, খুলনা ব্যুরো।