এক মলাটে ১০০ কৃষি প্রযুক্তি: অনন্য উদ্যোগ

0
343

মো: কামরুল ইসলাম ভূইয়া:
লেবার ভিসায় সৌদি আরবে গিয়েছিলেন বিএ পাস জহির আলি দশ বছর আগে। প্রথম দিকে খেজুর গাছ পরিষ্কারের কাজ করলেও শেষ ৪-৫ বছর তিনি মরুভূমিতে কৃষি কাজ করেছেন। কৃষিশ্রমিক হিসেবে মরুর শুষ্ক বুকে বিভিন্ন তাজা শাকসবজি ফলতে দেখেছেন। তখন থেকেই তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল দেশে এসে কৃষি কাজ করার। তারপর তিনি দেশে ফিরে আসেন বছর দুয়েক আগে। দেশে এসে কৃষিকাজে খুব আগ্রহী হয়ে পড়েন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে বাবার রয়েছে শত বিঘা জমি। বাবার জমিতে তিনি শুধু ধান চাষ নয়, অন্যান্য ফসলও চাষ করতে চান। অপ্রচলিত ফসল যেমন মাল্টা ও ড্রাগন ফল চাষে তাঁর আগ্রহ বেশি। একই সাথে নিচু জমিতে যেখানে বছরের ৬-৮ মাস পানি থাকে, সেখানে মাছ চাষ করতে চান। কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কীভাবে কোন ফসলটা চাষ করলে তাঁর জন্য লাভজনক হবে। তিনি স্থানীয় কৃষি অফিসের সাথে যোগাযোগ করেছেন, মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করেছেন। ফেসবুক, ইউটিউবে ভিডিও দেখেছেন। আবার পোল্ট্রি ফার্ম করার জন্য অন্য অফিসে ছোটাছুটি করেছেন। কিন্তু জহির আলি যেরকমটা চাচ্ছিলেন, সে রকম প্রয়োজনীয় তথ্য একসাথে এক জায়গায় পাচ্ছিলেন না। ছিল না কোনো একক প্রকাশনা বা বই।
জহির আলির মতো এরকম কৃষি উদ্যোক্তা বা কৃষির শিক্ষার্থী, গবেষক, সম্প্রসারণকর্মীসহ আগ্রহী যে কারও জন্য প্রাথমিকভাবে খুবই সহায়ক হতে পারে একটি বই। সেটি হলো ‘কৃষির শত প্রযুক্তির এটলাস’। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বাছাই করা সেরা ১০০টি প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বইটি প্রকাশ করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ স্মরণীয় করে রাখার জন্য সংস্থাটি শতপ্রযুক্তির বর্ণনাসমৃদ্ধ এই ‘এটলাস’ প্রকাশ করেছে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ এটলাসের মোড়ক উন্মোচন করেছেন। আপাতত বইটির কোনো দাম নির্ধারণ করা হয়নি ও খোলাবাজারে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আগ্রহীরা বিনামূল্যে ঢাকার ফার্মগেটে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত (এনএআরএস) এর এপেক্স বডি হিসেবে কাজ করে। এনএআরএসভুক্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি পৃথক মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৪টি কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এনএআরএসভুক্ত এসব জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬৫৫টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ৫৯১টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ১০০টি প্রযুক্তি এই এটলাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রযুক্তির পাশাপাশি এটলাসে প্রযুক্তি ব্যবহারে ২৫টি সাফল্যের গল্প আছে যাতে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।
১০০টি কৃষিপ্রযুক্তি এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে ২৫টি সাফল্যের গল্প সামগ্রিকভাবে কৃষির সকল ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এতে দানা জাতীয় ফসল, ডাল ও তৈলবীজ এবং আঁশ ও চিনি জাতীয় ফসল, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য সম্পদ, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বন, রেশম, চা, মৃত্তিকা সম্পদ, সেচপ্রযুক্তি, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা/সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে। বিশেষভাবে এসব প্রযুক্তি ও সফলতার গল্পে জৈব-অজৈব ঘাতসহিষ্ণুসহ ফসলের উচ্চফলনশীল জাত, হাইব্রিড এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
এটলাসটিতে ১৪টি ধান, ৮টি পাট এবং কেনাফ, ৪টি চিনি ফসল, ৫টি গম এবং ভুট্টা, ৮টি ডাল ও তেলবীজ এবং মশলা, ৮টি শাকসবজি, ১০টি ফল, ৫টি চা, ৫টি তুলা, ৫টি বনজ এবং বাঁশ, ৪টি রেশম, ৪টি মৃত্তিকা উন্নয়ন, ৫টি হাঁস-মুরগি ও প্রাণিসম্পদ, ৮টি মৎস্য ও জলজ পালন, ৩টি সেচ ও বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং ৪ টি কৃষি যন্ত্রপাতি প্রযুক্তিসহ মোট ১০০টি কৃষি প্রযুক্তি অর্ন্তভুক্ত আছে।
এটলাসের প্রতি পাতায় ১টি করে প্রযুক্তির সচিত্র বর্ণনা রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে এটলাসটি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় রচিত হয়েছে। প্রযুক্তির নাম ও শিরোনাম, উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, সংক্ষিপ্ত বিবরণ, উপযোগিতা বা চাষের পরিবেশ, প্রযুক্তিটির সুবিধা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা সংবলিত রয়েছে। যেমন প্রযুক্তি-১ এর শিরোনাম হলো ব্রি ধান ২৮: বোরো মৌসুমের জনপ্রিয় জাত বা প্রযুক্তি-১৫ এর শিরোনাম হলো বারি ড্রাগন ফল: দেশের সর্বত্র চাষোপযোগী জাত। এসব শিরোনাম দেখেই প্রাথমিকভাবে বুঝা যায় কি ফসল, কোথায় কখন চাষের উপযোগী।
-২-
উদাহরণস্বরূপ প্রযুক্তি-১৫তে বারি ড্রাগন ফল সম্পর্কে এটলাসে বর্ণনা করা হয়েছে- অনন্য স্বাদ, ঔষধি ও পুষ্টিগুণের কারণে ড্রাগন ফল বর্তমানে বাংলাদেশে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফলে পরিণত হয়েছে। বারি ড্রাগন ফল-১ হলো দেশে অন্যতম জনপ্রিয় জাত। এর বৈশিষ্ট্য হলো: নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চফলনশীল জাত, আকারে বড়ো, মিষ্টতার পরিমাণ ১৪ ভাগ ও খাদ্যোপযোগী অংশ ৮১ ভাগ; ১টি গাছ থেকে বছরে ২০-১০০টি ফল সংগ্রহ করা যায় এবং গড় ফলন ১৩ কেজি/প্রতি গাছে বা হেক্টর প্রতি ৬০ টন। উপযোগিতা হিসেবে বলা হয়েছে বাংলাদেশের যেকোনো উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে চাষোপযোগী একটি উন্নত জাত। সুবিধা হলো: এ ফল চাষ করে ১টি পিলার (৪টি গাছ) থেকে প্রায় ৩-৪ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব; প্রতি বিঘা জমি থেকে একজন চাষি খরচ বাদে ২-৩ লাখ টাকা লাভ করতে পারে, কিছুটা খরাসহিষ্ণু, বাজারমূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, এতে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব বর্ণনা থেকে একজন কৃষক, উদ্যোক্তা, কৃষির ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, সম্প্রসারণকর্মী বা আগ্রহী যে কেউ ড্রাগন ফল ও চাষের ব্যাপারে প্রাথমিক তথ্য পেয়ে যাবেন।
রয়েছে সাফল্যের গল্পও। যেমন বছরব্যাপী ফলনশীল বারি আম-১১ চাষে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছেন আমচাষি মেজর (অব.) মো: সোলাইমান। ৫ বছর আগে তিনি বারি আম-১১ এর একটি বাগান প্রতিষ্টা করেন। যেখানে ২০০টি ফলন্ত গাছ রয়েছে। গত বছর তিনি মোট ৩২ টন আম ৩২ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। এছাড়া, তিনি প্রতিবছর বারি আম-১১ আমের কলম তৈরি করে প্রতিটি ৩০০ টাকা করে বিক্রি করেন। আরেকটি সাফল্যের গল্পে রয়েছে পাবদা-গুলশা মাছ চাষ করে লাইলি বেগমের জীবনযাত্রার সংকট নিরসনের চিত্র। ময়মনসিংহের ফুলপুরের লাইলি বেগম বাড়ির পাশে ২৫ শতকের মজা পুকুরে কীভাবে পাবদা-গুলশা মাছ চাষ করে অসুস্থ স্বামী, ২ ছেলে ও ২ মেয়ের সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করছেন- তার সে প্রেরণামূলক গল্পও উঠে এসেছে মলাটের ভেতর। এরকম ২৫টি সাফল্যের গল্প দেশের হাজারো উদ্যোক্তা, জীবনসংগ্রামে ক্লিষ্ট মানুষ, বেকার যুবক, অসহায় নারী বা সাফল্য প্রত্যাশীদের নি:সন্দেহে অনুপ্রেরণা যোগাবে। আশার পথ দেখাবে।
এছাড়াও এটলাসটির শুরুতেই আছে ‘সাফল্যের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের কৃষি’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ যাতে কৃষিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, বর্তমানে কৃষির অগ্রযাত্রা, কৃষি উন্নয়নে গবেষণা-সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা, কৃষি উন্নয়নে ভবিষ্যৎ করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে কৃষির কিছু দৃশ্যমান প্রভাব এটলাসটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: যেমন, বিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়, পাটে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ, আলু ও আমে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। একইভাবে বিশ্বে বাংলাদেশ ইলিশ আহরণে প্রথম, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ আহরণে পঞ্চম, ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে চতুর্থ এবং গবাদিপ্রাণির সংখ্যায় দ্বাদশ স্থানে রয়েছে।
কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষিকে অগ্রাধিকারভুক্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও এগুলোর বিস্তার ঘটানো ছাড়া কৃষির সঠিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতের নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি, কৃষি গবেষণা সমন্বয়, পরিকল্পনা, গবেষণার বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই বিএআরসি কর্তৃক ‘১০০ কৃষিপ্রযুক্তির এটলাস’ প্রকাশ নি:সন্দেহে একটি গৌরবদীপ্ত অর্জন ও অনন্য উদ্যোগ।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশ বিশ্বে কৃষি উন্নয়নে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটলাসটিতে অন্তর্ভুক্ত প্রযুক্তি ও সাফল্যের গল্পসমূহ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে সহায়ক হবে। এটলাসটি আধুনিক কৃষি উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, কৃষি মন্ত্রণালয়