এইডস আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে

0
529

কামরুল হোসেন মনি:
বাবা-মায়ের ভুলের কারণে কিংবা অন্যদের সামান্য অসচেতনতার কারণে কোমলমতি অনেক শিশুই বহন করে চলেছে ভয়াবহ এইচআইভি/এইডস জীবাণু। কেবল রোগীরাই নন, সমাজে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে এ রোগে আক্রান্ত পরিবারের শিশুরাও। গর্ভবতী মায়েরাও অনেক সময় জানেন না, তিনি ওই জীবাণু বহন করছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সনাক্ত এইচআইভি/এইডস শনাক্ত হচ্ছে। গত ৪ মাসে খুলনা অঞ্চলে ১৩৩৭ জন গর্ভবতী মায়ের রক্তের পরীক্ষার মধ্যে ২ জনের এইচআইভি/এইডস পজিটিভ পাওয়া যায়। ইউনিসেফ এর আর্থিক সহযোগিতায় ‘এইচআইভি সেবা জোরদারকরণ প্রকল্প’ এর আওতায় বিনামূল্যে ওই গর্ভবতী মায়ের রক্ত পরীক্ষা ও শনাক্তকারীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন। খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এর সহযোগিতায় হাসপাতালেই এ সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত মায়ের গর্ভেও জন্ম নিচ্ছে সুস্থ সন্তান। এক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে নিয়মিত চেকআপ ও এন্টি রেক্ট্রোভাইরাল মেডিসিন ব্যবহার করে সম্পূর্ণ এইচআইভি/এইডস ভাইরাসমুক্ত শিশু পাওয়া সম্ভব।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ওই প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের তত্ত্বাবধানে এইচআইভি পজিটিভ গর্ভবতী মায়েদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া এইচআইভি এইড প্রতিরোধমূলক ওষুধ বিতরণ করা হয়।
খুমেক হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিট-২ এর সহকারী রেজিস্ট্রার বলেন, যে সব গর্ভবতী মায়েদের এইচআইভি পজিটিভ আছে জানতে পারেননি, তাদের ক্ষেত্রে বাচ্চাটির রিস্কটা বেশি থাকে। অনেক সময় শিশু মায়ের গর্ভে থাকায় অবস্থায় এইচআইভি পজিটিভ অবস্থায় রয়েছে। যদি গর্ভবতী থাকা অবস্থায় ওই পজিটিভ মা নিয়মিত ওষুধ সেবন করে সেক্ষেত্রে শিশুটির না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের এইচআইভি ও টিবি দুটো পজিটিভ সেক্ষেত্রে আমরা একই সাথে দুই ওষুধ রোগীকে সেবন করাতে পারি না। সেক্ষেত্রে বাচ্চাটা রিস্ক হয়ে যায়।
খুমেক হাসপাতালে নিচতলায় অবস্থিত ‘এইচআইভি সেবা জোরদারকরণ প্রকল্প’ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ইউনিসেফ এর আর্থিক সহযোগিতায় (ংঃৎবহমঃযবহরহম ড়ভ ঐওঠ ংবৎারপব) ‘এইচআইভি সেবা জোরদারকরণ প্রকল্প’ এর মাধ্যমে গর্ভবতী মায়ের বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষা ও আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করছে। এ পর্যন্ত ১৩৩৭ গর্ভবতী মায়েদের রক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দুইজনের শরীরে এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত করা হয়। ওই সূত্র মতে, ডিসেম্বর মাসে ২০৮ জন গর্ভবতী মায়ের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে একজনের এইডস পজিটিভ পাওয়া যায়। এছাড়া জানুয়ারি মাসে ৪৫০ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৪৩ জন ও মার্চ মাসে ৩৩৯ জন গর্ভবতী মায়ের রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া চলিত মাসে ৬২৮ জনের মধ্যে ১ জনের এইচআইভি পজিটিভি শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলাকে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সবকিছু বিানমূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে।
ওই প্রকল্পে খুমেক শাখার কাউন্সিলর আবু মোহাম্মাদ আলী জাবেদ বলেন, এইডস আক্রান্ত মায়ের গর্ভেও জন্ম নিচ্ছে সুস্থ সন্তান। সেক্ষেত্রে নিয়মিত চেকআপ ও এন্টি রেক্ট্রোভাইরাল মেডিসিন ব্যবহার করে সম্পূর্ণ এইচআইভি ভাইরাসমুক্ত শিশু জন্মে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় শতভাগ সফলতা। খুলনায় এমনই একজন গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছি। তিনি বলেন, হাসপাতালে তাদের মাধ্যমে ইনডোর ও আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসা গর্ভবতী মায়েদের রক্ত পরীক্ষা করানো হচ্ছে। এছাড়া হিজড়া, সেক্স ওর্য়াকারসহ সাধারণ মানুষও নিজ উদ্যোগে রক্ত পরীক্ষা করাচ্ছেন। কাউন্সিলর আঁখি নূর বলেন, দুইজন গর্ভবতী মায়ের এইচআইভি শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা কোন না কোন সময় বাইরে থেকে রক্ত কিনে এনে শরীরের দিয়েছেন। সেখান থেকে হয়তো এইচআইভি পজিটিভ ছিল।
ওই প্রকল্পের প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ইউনিসেফের সহযোগিতায় দুই বছর মেয়াদী এ প্রকল্প চালু করা হয়। আগামী ২০১৯ সালে ১৪ নভেম্বর প্রকল্পটি শেষ হবে। তিনি বলেন, কোন ব্যক্তি রক্ত কিনে নেওয়ার সময় রক্ত স্ক্রিনিং করলেও কোন ভাইরাস আছে কি না বিষয়টি যেন সে চেক করে নেন। তিনি বলেন, তাদের এ সেবা আরবান হেলথ ক্লিনিক, সদর হাসপাতাল, সূর্যের হাসি ক্লিনিক, আদ্ব-দ্বিন হাসপাতাল ও গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের এ সেবার আওতাধীন রয়েছে। কোন গর্ভবতী মহিলা রক্ত পরীক্ষার পর এইচআইভি পজিটিভ হলে চিকিৎসাসেবার জন্য তাদের কাছে প্রেরণ করা হচ্ছে। খুমেক হাসপাতালের নিচতলার বহিঃবিভাগে ১১১নং রুমে, আন্তঃবিভাগে লেবার ও গাইনী ওয়ার্ডে গর্ভবতী মায়েদের রক্ত পরীক্ষা এবং ২২১নং রুমে রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তিদের এআরটি সেবা প্রদান করা হয়।
‘এইচআইভি সেবা জোরদারকরণ প্রকল্প’ অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতিমাসে কোন না কোন জায়গায় এইচআইভি এইডস পজিটিভ সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। দুইজন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে পজিটিভ পাওয়ার মধ্যে একজনের বাসস্থান খুলনাঞ্চলে অপরটি যশোর কেশবপুর এলাকায়।
মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ খুলনার সূত্র থেকে জানা যায়, ২০০৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১৪ বছরে ২৫২ জন শরীরের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস শনাক্ত করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে মারা যান ৫৯ জন। ওই সূত্র মতে, ওই সময় পর্যন্ত জীবিত ছিল মোট ১৯৩ জন। যার মধ্যে পুরুষ ৮৮ জন, মহিলা ৭৩ জন, হিজড়া ১ জন, শিশু রয়েছে ২৯ জন। যার মধ্যে শিশু পুত্র ১৮ ও কন্যা ১১ জন পজিটিভ। উল্লিখিত পরিসংখ্যানের মধ্যে ২০১৭ সালে খুলনায় আক্রান্ত সংখ্যা ৩৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২১ জন, মহিলা ১৫ জন, হিজড়া ১ জন ও শিশু পুত্র ২ জন। এ পর্যন্ত খুলনাঞ্চলে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে পুরুষ ৫৩ ও মহিলা ৩১ জন রয়েছে। যার মধ্যে শিশু রয়েছে ১০ জন।
একটি সূত্র মতে, এইডস আক্রান্ত শিশুদের বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তাদের নিয়ে মায়েরাও পড়েছেন বিপাকে। প্রয়োজনীয় ওষুধ-চিকিৎসা পেলেও বেঁচে থাকার জন্য একমুঠো খাবার জোগাড় করতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে তাদের এক রকম লুকিয়ে বাঁচতে হচ্ছে। এছাড়া পুষ্টির অভাবে এসব শিশুর দ্রুত মৃত্যু ঘটছে। দেশে এইডস আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে তাদের মৃত্যুর সংখ্যাও।