আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে গণমাধ্যমের বিকাশ

0
408

টাইমস ডেস্ক:
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নদী-ছায়াঘেরা একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নিয়েও করেছিলেন বিশ্বজয়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে আমৃত্যু বাঙালি জাতির প্রধান আকর্ষণ ছিলেন তিনি। তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাস।
তরুণ শেখ মুজিব মুজিবুর রহমান ক্রমেই যেভাবে বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা এবং স্বাধীনতার স্থপতি হয়ে উঠেছেন, তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার যোগাযোগ কৌশল। আওয়ামী লীগের কাÐারি হিসেবে দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ১৯৪২ সালে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ শেষ করে, তরুণ শেখ মুজিব যখন কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান, তখন থেকেই তিনি সরাসরি ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতে জাতীয় পরিসরে রাজনীতি করা। তাই অবিভক্ত বাংলার কিংবদন্দি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন তিনি। তরুণ নেতা হিসেবে শেখ মুজিব সবার দৃষ্টিনন্দিত হন। এই সময় থেকে সংবাদপত্র অফিসে তার যাতায়াত শুরু। কলকাতার দৈনিক আজাদ অফিসে সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে মাঝেমাঝেই আডডা দিতেন। কলকাতার জীবনে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন তরুণ মুজিব, তাই অনেক সময় মুসলিম লীগের প্রেসরিলিজ নিয়েও পত্রিকা অফিসে যেতে হতো তাকে। একসময় তার উপলব্ধিতে আসে যে, মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপকে সমর্থন করে। তাই ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আর্থিক সহযোগিতায় দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকা প্রকাশ করেন তারা। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমেদ। পত্রিকাটি সেই সময়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে একটি আধুনিক পত্রিকা হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পত্রিকা বিপণনের কাজে শেখ মুজিব নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। পত্রিকার ব্যবস্থাপনার কাজেও তিনি একজন দায়িত্বশীল পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশ হতো। শেখ মুজিব পত্রিকার ঢাকার অফিসে সার্কুলেশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন এবং পূর্ববাংলায় এজেন্ট নিয়োগ করে এর ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত বলে পূর্ববাংলায় এই পত্রিকার প্রচার নিষিদ্ধ করে দেয় খাজা নাজিমউদ্দিনের সরকার।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে দলের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়। মওলানা ভাসানী ছিলেন সম্পাদক, ইয়ার মোহাম্মদ খান ছিলেন প্রকাশক, কিন্তু পত্রিকা পরিচালনার সকল দায়িত্ব পালন করতেন তফাজ্জল হোসনে (মানিক মিয়া)। পত্রিকার অর্থসাহায্য করতেন হোসনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিব এই পত্রিকা বিক্রির কাজও করেছেন ঢাকায়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পূর্বে, ১৯৫৩ সালে, ইত্তেফাক সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। আর তফাজ্জল হোসেন এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে পূর্ব-বাংলায় ৯২ (ক) ধারা প্রবর্তন করে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার ও অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেসময় দৈনিক ইত্তেফাকও বন্ধ ছিল। কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে তফাজ্জল হোসেন জানান, তিনি আর কাগজ বের করবেন না। করাচিতে একটা চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। শেখ মুজিব তাকে সেদিন অনুরােধ করেছিলেন- আপনি যাবেন না। আপনি চলে গেলে ইত্তেফাক আর কেউ চালাতে পারবে না। তফাজ্জল হোসেন পরদিন তাকে খবর পাঠান যে, তিনি করাচি যাচ্ছেন না। শেখ মুজিবের সঙ্গে তফাজ্জল হোসেনের গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। শেখ মুজিবের অনুরোধে প্রথম তাকে সোহরাওয়ার্দী দৈনিক ইত্তেফাকের সেক্রেটারি নিয়োগ করে পত্রিকার প্রশাসন ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি উত্থাপন করলে, এর পক্ষে দৈনিক ইত্তেফাক জনমত গড়ে তুলে পাকস্তানি জেনারেলের ক্ষমতার ভিত নড়িয়ে দেয়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় এদেশের পত্রিকাগুলো একটি সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র দ্রোহিতার অভিযোগে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়, তার শুনানি-পর্বের কোর্ট- রিপোর্টিং ধারাবাহিকভাবে দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হতো। একদিকে ছাত্র-গণআন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি, আবার রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে পূর্বপাকিস্তান জুড়ে প্রতিদিন মিছিল সভা-সমাবেশ শুরু হয়। জেনারেল আইয়ুব বাধ্য হয়ে সব দাবি মেনে নয়ে। ওই সময়ে পত্রিকাগুলো সংবাদ, কলাম ও সম্পাদকীয় লিখে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন-বৈষম্যের কথাগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরেছিল। পরবর্তীতে সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও দৈনিক পত্রিকাগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছিল। তারা শেখ মুজিবের সকল সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা, বিবৃতি ও ভাষণ ছবিসহ প্রথম পৃষ্ঠায় বড়-বড় টাইপে ছাপাত। বলা চলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ও জনমানস গড়ে তুলতে পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বের পক্ষে পূর্ণ সমর্থন রেখেছে।
শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ভাষণের পর থেকে বাঙালির স্থাধীনসত্তা প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আর কোনো প্রশ্ন তখন কেউ তোলেনি। সমগ্র জাতি এক হয়ে গিয়েছিল। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোয় শেখ মুজিবই ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা, তার নেতৃত্বই ছিল গ্রহণযোগ্য।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের পর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত, পত্রিকাগুলো পাকিস্তানি-সামরিক বাহিনীর নির্দেশনা মেনে সংবাদ প্রকাশে বাধ্য ছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের সংবাদ নিয়ে আবার তারা আগের মতো সাহসী ভূমিকা পালন করে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ‘ঐ মহামানব আসে’ হিসেবে পত্রিকাগুলো আখ্যায়িত করে।
স্বাধীনতার পর, মাত্র সাড়ে তিন বছর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান দেশ শাসন করেন। সেই স্বল্প সময়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তিনি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করান। তবে এজন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা ছিল, দেশের মানুষও পরিশ্রম করেছে প্রচুর।
বিধ্বস্ত ব্রিজগুলো নির্মাণ, ফেরি জোগাড় করে পরিবহনব্যবস্থা উন্নত, সমুদ্রবন্দরকে স্থলমাইন মুক্ত করা, অস্ত্র সমর্পণ করানো, ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো, কৃষি উৎপাদনে উদ্যোগ গ্রহণ, প্রশাসনকে গতিশীল করা ইত্যাদি নানা কাজে সবসময় উদ্যোগী ও আন্তরিক ভূমিকা নিয়েছেন।
আর এসময় থেকে কোনো কোনো পত্রিকা ও সাংবাদিক শেখ মুজিবের বিরুদ্ধাচরণ, সমালোচনামূলক লেখা শুরু করেন। তারা বঙ্গবন্ধুর দেশশাসনের ন্যূনতম ভুল-ত্রুটিকে তীক্ষভাবে আক্রমণ করেছেন।
পরবর্তীতে যখন বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠিত হলো, তখন ওই সাংবাদিকরাই শেখ মুজিবের পরামর্শক হয়ে উঠলেন। তাদের পরামর্শে দেশে মাত্র চারটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক প্রকাশনা রেখে অন্যসব কাগজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বন্ধ হয়ে যাওয়া সাংবাদিকদের অন্য চাকরি দেওয়া হয়েছিল। চাকরি না-হওয়া পর্যন্ত সবাইকে বেতন দেওয়া হতো। অথচ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘাতকের বুলেটে নিহত হওয়ার পর এসব পরামর্শক সাংবাদিকরা তার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তারা স্বৈরাচার জিয়ার পাকিস্তানি স্টাইলে দেশশাসন ও একাত্তরের ঘাতক-দালালদের প্রশ্রয়কে সমর্থন করেছেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে শেখ মুজিবের একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। দেশে-বিদেশে যেখানে যখন সফরে গিয়েছেন, একদল সাংবাদিক তার সঙ্গে থেকেছেন। তিনি সাংবাদিকদের কাছ থেকে মতামত নিতেন। বিদেশি সাংবাদিকরা তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। তাদের কাছে তিনি একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
ঐতহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের জন্য লন্ডন টাইমস ও নিউইয়র্কের নিউজ উইক পত্রিকা তাকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটা এক বিরল সম্মান। ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। ভয়েস অব আমেরিকা ও বিবিসি’র বাংলা বিভাগ সরাসরি শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সাক্ষাৎকার ও মন্তব্য নিতেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুসম্পর্ক থাকলেও, তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখনও অনেক পত্রিকা তার সমালোচনা করে খবর ও কলাম প্রকাশ করত। তবে তারা তার ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা, দূরদর্শিতার প্রশংসা করতেও বাধ্য হতো।
তিনি সাংবাদিকদের স্বাধীনচেতা হিসেবে দেখতে চাইতেন, কিন্তু পাশাপাশি দেশ ও জাতির স্বার্থকে বড় করে দেখার পরামর্শ দিতেন। তাদের বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে গঠনমূলক সমালোচনা করার আহ্বান জানাতেন।
তিনি সংবাদশিল্পকে অত্যন্ত মর্যাদার আসন দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ক্ষতিগ্রস্ত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দুটিকে পুনরায় নিজের পায়ে দাঁড় করাতে সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন।
(সূত্র: আওয়ামী লীগ অফিস ও সিআরআই)