অভিযোগের অন্ত নেই : খুলনা জেলা আ’লীগের প্রস্তাবিত কমিটি

0
648

সুমন আহমেদ : দলের প্রাথমিক সদস্য নন। ওয়ার্ড বা ইউনিয়নের কমিটিতে নাম নেই। আদৌ দল বা সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মি কখনো ছিলেন না। এমনকি দলের প্রাথমিক সদস্য নন। তবুও পদভুক্ত হয়েছেন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে। উপরুন্তু তালিকায় নাম আছে যুদ্ধাপরাধী, জামায়াত পরিবারের সন্তান, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভ্ঙ্গায় অভিযুক্ত ও সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য। মোটকথা খুলনা জেলা আওয়মী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন, অনিয়ম ও প্রীতির অভিযোগ তৃনমূলের। পাশাপাশি এক ঝাঁক সক্রিয় নেতার বদলে অন্তরভুক্ত হয়েছে নিষ্ক্রিয়দের নাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডুমুরিয়া উপজেলার খর্নিয়া ইউনিয়নের জামায়াত সভাপতি ও গোনআলী গ্রামের বাসিন্দা বাবর আলী সরদার এবং জামায়াতের সুরা সদস্য সাহিদা বেগম দম্পতির সন্তান নুরুল ইসলাম বাদশা।পদ পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ সম্পাদক । এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। এনিয়ে ও এলাকায় দলের তৃনমূলের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ পূঞ্জিভূত হয়ে আছে।
আরও জানা গেছে, চারদলীয় জোটের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগর লবীর আস্থাভাজন বলে খ্যাত মোস্তাফা সরোয়ার নাম এসেছে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদে। ২০০১ সালের সে আলোচিত খুলনা বেতার কেন্দ্রে স্থাপিত জাতির জনকের ভাষ্কর্যের অপূরণীয় ক্ষতিসাধনকারি চক্রের অন্যতম একজন। তখন এই চক্র বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের কনিষ্ঠ আঙুল ভেঙে ফেলে। এছাড়া এই চক্র খুলনাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের দূর্লভ সাক্ষাতকারের ৪২টি টেপ মুছে ফেলে। এনিয়ে বিস্তারিত অভিযোগের বর্ণনা তুলে ধরে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই খুলনা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেন জনৈক এনামুল হক ফারুক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে খুলনা জেলা প্রশাসন অভিযোগ তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করে। তবে তার অগ্রগতি হয়নি অভিমত ক্ষুব্দ নেতাকর্মীর। এছাড়া এই ঘটনায় ২০০৯ সালে ৬ আগস্ট গোপালগঞ্জের বাসিন্দা ও বেতার মসজিদের ইমাম আনিসুর রহমান কেএমপি’র সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরী (নং ২৯৭) করেন।
ডুমুরিয়ার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্যমতে, ২০০৯ সালে ইউপি চেয়ারম্যান পদে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভোটাভুটিতে মনোনীত হন কাজী নুরুল ইসলাম। সে অনুযায়ী উপজেলা ও জেলা কমিটি হয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে প্রস্তাবনা যায়। তবে অদৃশ্য ছায়াবলে মোস্তফা নৌকার প্রার্থী বনে যান। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এনিয়ে মানববন্ধন ও মিছিল করে।
দলের সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে জাপার প্রার্থী হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিনয় কৃষ্ণ রায় প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে নির্বাচন করেন। পরে সে আওয়ামী লীগের যোগদান করেন। বর্তমানে সে দাকোপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সে প্রস্তাবিত কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছে। এছাড়া অতশী সরকার ও দান কুমারী কখনও দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবু তাদের নাম এসেছে কমিটিতে। এছাড়া সনৎ কুমার বিশ্বাস সদস্য হয়েছে প্রস্তাবিত কমিটির। সে ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিনয় কৃষ্ণ রায়ের সাথে জাপার হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। বর্তমানে সে চালনা পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
সূত্রমতে, প্রস্তাবিত কমিটিতে বটিয়াঘাটা উপজেলার বাসিন্দা ও সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায়কে সহসভাপতি করা হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে পাইকগাছা উপজেলার বাসিন্দা প্রকৌশলী প্রেম কুমারকে। তারা কখনোই খুলনা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। কমিটিতে পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন শেখ মনিরুুল ইসলাম ও ডুমুরিয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন এজাজ আহমেদ। শেখ মনিরুল ইসলামকে সহসভাপতি এবং এজাজ আহমেদকে প্রস্তবিত কমিটিতে উপ-প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে। নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে এজাজের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন এবিএম শফিকুল ইসলাম। তাকে কৃষি ও সমবায় সম্পাদক করা হয়েছে। খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অসিত বরণ বিশ্বাসকে করা হয়েছে তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন অনেকে।
এদিকে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং সংরক্ষিত সাংসদ গেøারিয়া ঝর্ণার বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত কমিটিতে গঠনতন্ত্র লংঘন, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে আবেদন করেছেন জেলার সাবেক দপ্তর সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান বাবুল। জাতির পিতা ম্যুরাল ভাংচুরকারী, রাজাকারে সন্তান, মৃণাল বাহিনীর সদস্য, স্বজনপ্রীতি এবং দলের প্রাথমিক সদস্য নন, এমন ১৯ জনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও দপ্তর-উপ দপ্তর সম্পাদকের কাছে অভিযোগ করেছেন তিনি।
অভিযোগে বলা হয়, প্রাথমিক সদস্য নন এবং দূর্নীতি মামলার আসামী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার রায়কে সহ-সভাপতি করা হয়েছে জেলা কমিটিতে। এছাড়া প্রাথমিক সদস্য নন এবং জামায়াতের আমীর বাবর আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম বাদশাকে শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক করা হয়েছে। প্রাথমিক সদস্য নন এবং রাজাকার ওয়াহাব মোল্লার পুত্র প্রভাষক মনোয়ার হোসেনকে সদস্য, প্রাথমিক সদস্য নন দর্জি মোজাফফর মোল্যাকে শ্রম সম্পাদক, নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী মনিরুল ইসলামকে সহ-সভাপতি, কেন্দ্রীয় উপ-কমিটি থেকে বহিষ্কৃত এসএম জাহিদুর রহমানকে কোষাধ্যক্ষ, প্রাথমিক সদস্য নন গাজী মামুনুর রশিদকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক, প্রাথমিক সদস্য নন প্রেম চাঁদ মন্ডলকে সাংগঠনিক সম্পাদক, নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী গাজী এজাজ আহমেদকে উপ-প্রচার সম্পাদক, প্রাথমিক সদস্য নন ও জাতির পিতার মুর‌্যাল ভাংচুরকারী, বিতর্কিত একদা বিএনপি’র ডাকসাইটে সাংবাদিক মোস্তফা সরোয়ারকে নির্বাহী সদস্য, প্রাথমিক সদস্য নন মৃণাল কান্তি বিশ্বাসকে দপ্তর সম্পাদক, প্রাথমিক সদস্য নন শ্রীমন্ত অধিকারী রাহুলকে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক, প্রাথমিক সদস্য নন সংরক্ষিত সাংসদ গেøারিয়া ঝর্ণার বোন অতশী সরকারকে সদস্য, প্রাথমিক সদস্য নন দান কুমারী বিশ্বাসকে সদস্য, প্রাথমিক সদস্য নন গেøারিয়া ঝর্ণা এমপির নিকট আত্মীয় লিপিকা বৈরাগীকে সদস্য, প্রাথমিক সদস্য নন নিক্সন ঘোষকে সদস্য, সরদার ইলিয়াস হোসেনকে সদস্যসহ অনেককে স্বজনপ্রীতি করে গঠনতন্ত্রের ৫ (২) ধারা লংঘন করে দলের খুলনা জেলা কমিটিতে অন্তভ‚ক্তি করা হয়েছে।
একই অভিযোগের আরও বলা হয়, অপরদিকে ত্যাগী ও পরীক্ষীত বাদ পড়া নেতাদের মধ্যে রয়েছে বিগত কমিটির সদস্য অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান বুলবুল, বিগত কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মোকলেসুর রহমান বুলবুল, বিগত কমিটির সদস্য মালিক সরোয়ার উদ্দিন, বিগত কমিটি সদস্য আব্দুল মজিদ ফকির, বিগত কমিটির শিক্ষা ও মানব সম্পাদক সম্পাদক অধ্যাপক মিজানুর রহমান, বিগত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নুরুজ্জামান, বিগত কমিটির সদস্য ফারহানা হালিম, বিগত কমিটির আইন সম্পাদক এড. রবীন্দ্র নাথ মন্ডল, বিগত কমিটির সদস্য এড. মোস্তাফিজুর রহমান কালু, বিগত কমিটির উপ-প্রচার সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম, উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিগত কমিটির সদস্য মারুফ হোসেন, বিগত কমিটির সদস্য মুনসুর আলী।
খসড়া ওই কমিটিতে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক এসএম মোস্তফা রশিদী সুজার অনুসারীদেরও কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পৃথক তালিকা নিয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যান জেলা সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুজিত কুমার অধিকারী। দুই দফায় মিটিং বসেও তারা একমত হতে পারেননি। ১৯ সেপ্টেম্বর তারা খুলনায় ফিরে আসেন। পরদিন রাতেই একটি খসড়া কমিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুজিত কুমার অধিকারী বলেন, পুরোনো ও ত্যাগীদের কমিটি থেকে বাদ পড়েছে। প্রাথমিক সদস্য নন, এমন অনেকেই কমিটিতে প্রস্তাবিত কমিটিতে নাম আসছে। এক সাংসদের কোটায় পাঁচজন জায়গা পেয়েছেন, যাদের নাম কেউ কখনও শোনেনি। এসব বিষয়ে প্রয়োজনে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নালিশ হবে বলে তিনি জানান। এছাড়া নুরুল ইসলাম বাদশা জামায়াতের পরিবারের সন্তান বলে নিশ্চিত করেন তিনি। মোস্তফা সরোয়ারের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য’র আঙ্গুল ভেঙে ফেলার প্রশ্নে তিনি বলেন, যেহেতু নেত্রীর মনোনয়নে সে নৌকার প্রার্থী হয়েছে, তাই তার পদ নিয়ে সভাপতি-সম্পাদকের আপত্তি ওঠেনি।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ বলেন, দলের জেলা কমিটিতে জামায়াত পরিবারের সদস্য, বিতর্কিত ব্যাক্তি ও হাইব্রীডদের ঠাঁই হবে না। প্রস্তাবিত কমিটিতে এমনসব বিতর্কিতদের ব্যাপারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকসহ কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড এনিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। যাচাই-বাছাই শেষে অচিরেই একটি স্বচ্ছ কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদন হবে এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।