অনন্য বঙ্গবন্ধু#### প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব

0
393
মোঃ নজরুল ইসলাম,তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ,খুলনা মহানগর।
বঙ্গবন্ধু তার ৩৫-৩৬ বছরের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনে বারবার বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতার কারনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,মাওলানা ভাসানী,শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক,শামসুল হক এবং মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের মত কিংবদন্তীতুল্য নেতাদের ছাপিয়ে বাঙালীর একক এবং অনন্য নেতায় পরিণত হতে পেরেছেন।দীর্ঘ ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ভারত উপমহাদেশ বিভাজিত হয়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অভ্যূদয় হয়েছিল।প্রতিষ্ঠার ছয় মাস না যেতেই রাষ্ট্র ভাষা বিষয়ে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরাচারী মনোভাবের কারনে সেই প্রত্যাশায় ফাটল ধরে।যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সহ তৎকালীন পূর্ব বাংলার ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের সৃষ্টি হয়।সংগঠনটি সৃষ্টির সূচনালগ্নে সংগঠনের নামের সাথে মুসলিম শব্দটি যুক্ত করা বা বাদ দেওয়ার বিষয়ে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা অলি আহাদ এবং মোঃ তোয়াহা সহ একটা অংশ ছাত্রলীগের নামের পূর্বে মুসলিম শব্দটি যুক্ত করার ঘোরবিরোধী ছিলেন।অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নাঈমউদ্দীন আহমেদ,দবিরুল ইসলাম,খালেক নেওয়াজ খান সহ একটা অংশ ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটা রাষ্ট্রের ছাত্র সংগঠনের নামের পূর্বে কৌশলগত কারনে মুসলিম শব্দটি যুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন।শেষমেশ বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়।পরবর্তীতে বাংলা ভাষার আন্দোলন জোরদার হওয়ার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা এমনকি নিচু শ্রেণির ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করল।বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৫৩ সালে ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ করা হল।সময়ের প্রেক্ষাপটে যা ছিল অত্যন্ত আকাঙ্খিত এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে শুধুমাত্র মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ১৯৫৫ সালে সকল ধর্ম,বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ’ করার মাওলানা ভাসানীর সিদ্ধান্তের পক্ষে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা নেন।অন্যদিকে হোসেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে আব্দুস সালাম খান,খন্দকার মোশতাক আহমদ সহ অনেকেই মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন।শেষমেশ বঙ্গবন্ধুর জোরালো প্রচেষ্টার কারনে আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সংগঠনের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
####অনন্য বঙ্গবন্ধু####(দ্বিতীয় পর্ব)
১৯৫৬ সালে দলের সাধারন সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীত্ব গ্রহণ নিয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদের নেতৃত্বে একটি অংশ দলের মধ্যে বলয় সৃষ্টির অপচেষ্টা চালান।সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু সংগঠনকে শক্তিশালী করার স্বার্থে ১৯৫৭ সালে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে দলের সাধারন সম্পাদক পদে বহাল থাকেন।কারন বঙ্গবন্ধু জানতেন এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ে শক্তিশালী সংগঠনের কোন বিকল্প নেই।পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে দলের দায়িত্ব ধরে রাখা বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক নৈপুণ্যেরই পরিচায়ক।সেদিন বঙ্গবন্ধু ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটি আজও পেতাম কিনা সন্দেহ আছে।বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকবে।১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামীলীগ সভাপতি মাওলানা ভাসানীর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রেক্ষিতে মাওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়।বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে ভূমিকা নেন।সোহরাওয়ার্দী এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দলের বেশিরভাগ নেতা মাওলানা ভাসানীর প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।এ কারনে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ইয়ার মোহাম্মদ খান,অলি আহাদ সহ অনেক নেতা আওয়ামীলীগ থেকে ১৮ ই মার্চ পদত্যাগ করেন।আওয়ামীলীগ থেকে পদত্যাগ করে মাওলানা ভাসানী ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ গঠন করলেও বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তে আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী কমিটি ভাসানী সাহেবের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি।ভাসানী সাহেবের পদত্যাগের পরও পরবর্তী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় ভাসানী সাহেবকেই আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয় মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশকে। রাজনীতিতে এ ধরনের নজীর বিরল।৬৬ তে ৬ দফা দেওয়ার পর দলের অনেক নেতা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে,৬ দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।৬৬ সালের যে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন-“৬ দফার প্রশ্নে কোন আপোষ নেই।রাজনীতিতেও কোন সংক্ষিপ্ত পথ নেই।নেতৃবৃন্দের ঐক্যেও আওয়ামীলীগ আর আস্থাশীল নয়।নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নে নিবেদিতপ্রাণ কর্মিদের ঐক্যেই আওয়ামীলীগ আস্থাশীল।আওয়ামীলীগ নেতার দল নয়,এ প্রতিষ্ঠান কর্মিদের প্রতিষ্ঠান।” বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন-“সাঁকো দিলাম,স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।এই আন্দোলনে কেউ যদি নাও আসে আমরা একাই রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাব।ভবিষ্যত ইতিহাস প্রমাণ করবে আমাদের মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।” বস্তুত ৬ দফা ছিল বাঙালীর স্বাধীনতার বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর। ৬ দফার আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বারবার কারাবরণ করেছেন।৬ দফা দেওয়ার পর দাবি আদায়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু ৩২ টি জনসভা করে ৮ বার গ্রেফতার হয়েছেন।কিন্তু ৬ দফার প্রশ্নে আপোষ করেন নি।৬ দফা আন্দোলনে আটক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছিল।বঙ্গবন্ধু সহ রাজবন্দীদের মুক্তির আন্দোলন এক পর্যায়ে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে রুপ নিয়েছিল।৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়েছিলেন এবং তুমুল আন্দোলনে স্বৈরশাসক লৌহমানব আইয়ু্ব খানের পতন হয়েছিল।যার ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৭০’র ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।বঙ্গবন্ধু জানতেন জনরায় ছাড়া জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া বাঙালীর আকাঙ্খিত স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।এ কারনেই বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের দাবি করেছিলেন এবং ৭০’র নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।অথচ মাওলানা ভাসানী সহ অনেক সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ৭০’র নির্বাচনে অংশগ্রহণে তীব্রভাবে আপত্তি জানিয়েছিলেন।কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণ হয়েছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।৭০’র নির্বাচনে বিপুল ম্যান্ডেট বাংলার মানুষের স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন যে যৌক্তিক ছিল সেটিই বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দেয়।এ কারনেই ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে ভারত,রাশিয়া সহ অনেক রাষ্ট্রই আমাদের পক্ষে জোরালো সমর্থন দেন।ফলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়।যার ফলাফল আজকের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।এ কারনেই বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশ নয়,পৃথিবীর রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য নেতা।