১০ বছর ধরে উপেক্ষিত সড়ক নিরাপত্তায় হাইকোর্টের রায়

0
333

 খুলনাটাইমস অনলাইন ডেস্কঃসড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য ২০০৮ সালে হাইকোর্টের দেওয়া রায় ১০ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। ওই রায়ে উন্নত বিশ্বের আদলে দেশের সব গাড়িতে গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র স্থাপন (স্পিড গার্ড বা গভর্নর) এবং কেন্দ্রীয়ভাবে তা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঁচটি আধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে বলা হয়েছিল। অথচ ওই রায় বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ফলে চালকের অবহেলা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে চলেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ১১ থেকে ১২ হাজারের মধ্যে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে এই সংখ্যা সাড়ে আট হাজার। আর পুলিশের তথ্য বলছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ। তবে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে রাজধানীতেই প্রাণহানি সবচেয়ে বেশি হয় বলে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জরিপে উঠে এসেছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের শহরাঞ্চলে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই ঘটে রাজধানীতে। আর এই পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালে হাইকোর্টের দেওয়া রায় অনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ এবং যানবাহনে স্পিড গভর্নর স্থাপনের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।

অবশ্য সরকারের সদিচ্ছার অভাবে হাইকোর্টের ওই রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন সদ্য অবসরে যাওয়া বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি সমকালকে বলেন, সদিচ্ছার অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গত বছরের আগস্টে দীর্ঘ গবেষণার পর একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল। তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে মহাসড়কে চলাচলরত যানবাহনের গতি ডিজিটাল পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। যদি কোনো চালক নির্ধারিত সীমার বেশি গতিতে যান চালায়, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যাবে। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে গাড়ির গতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। উন্নত দেশগুলোতে এভাবেই গাড়ির গতিসহ অন্যান্য বিষয় মহাসড়কে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এটা সম্ভব বলেই আদালত সব কিছু পর্যালোচনা করে রায় দিয়েছিলেন। তখন বিআরটিএর মতামতও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন ওই রায় অনুসারে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ হোক- এটা সরকারি সংস্থাগুলোই চাইছে না।

২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজধানীর সিটি কলেজের ছাত্রী সাজিয়া আফরিন সুচি কলেজের সামনে একটি গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যান। পরদিন ১২ ডিসেম্বর ‘অকালে ঝরে গেল সুচি’ এই শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদন নজরে এলে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন (পরে প্রধান বিচারপতি) হাইকোর্ট বেঞ্চ পরদিন স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। রুল শুনানি শেষে ২০০৮ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ২০০৯ সালের ১০ মার্চের মধ্যে প্রত্যেকটি গাড়িতে গতি নিয়ন্ত্রক স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করে ওই তারিখে হাইকোর্টকে জানাতে বলা হয়েছিল। বিআরটিএসহ সংশ্নিষ্ট বিবাদীদের এ আদেশ দেওয়া হয়। পরে সম্পূরক অপর একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই রায়ে কিছু সংশোধনী আনেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ রিটটি করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ পর্যবেক্ষণের কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হলেও কেন্দ্রীয়ভাবে পাঁচটি ল্যাবরেটরি স্থাপনে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে সেই প্রস্তাব এখনও ঝুলে রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, বিআরটিএ এবং সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি আরও বলেন, রায় বাস্তবায়নের জন্য বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে কয়েক দফা তাগাদা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু অগ্রগতি শূন্য। সবশেষে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে ঢাকায় কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরি স্থাপনের কাজ শিগগিরই শুরু হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়ে রায় প্রদানকারী আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সমকালকে বলেন, বিদ্যমান আইন ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যদি সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ হতো, তাহলেও অনেকাংশে দুর্ঘটনা কমে যেত। দুর্ঘটনা রোধে যানবাহনে গতি নিয়ন্ত্রক স্থাপন-সংক্রান্ত তার দেওয়া রায়ের কথা উল্লেখ করে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, আইনে গাড়ির গতির যে সীমা বলা আছে, সে সীমার মধ্যে রাখা গেলে দুর্ঘটনা বহুলাংশে কমবে। মোটরযান বিধিমালায়ও আছে, গাড়িতে বাধ্যতামূলকভাবে গভর্নর সিল লাগানোর বিষয়টি; কিন্তু রায়টি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

অবশ্য হাইকোর্টের রায় কার্যকরে প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান। তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চলছে। অবশ্যই রায় বাস্তবায়ন হবে। বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যানবাহনে গতি নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে গভর্নর সিল স্থাপন করা শুরু হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

এদিকে, সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের (নিসচা) প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালক ও পথচারীদের অসাবধানতা এবং বেপরোয়া গতিতে যান চলাচল। এ দুটি প্রবণতা বন্ধ করতে দরকার সচেতনতা। শুধু সচেতনতা বাড়িয়ে বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশেই সড়ক দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে, যার মধ্যে সুইডেনও রয়েছে। তাই সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশেও সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে।