সাতক্ষীরা প্রতিনিধি:
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের মিঠা পানির পুকুরে লবণ পানি প্রবেশ করেছে। ফলে মিঠা পানির পুকুরগুলো লবণ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। এসব মিঠা পুকুরের পানি বনের বাঘ ও মায়াবী হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, বনজীবী, পর্যটক ও বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মিঠাপানির একমাত্র উৎস ছিল। এমনকি জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনে যাওয়া কয়েক লাখ মৎস্যজীবী, মৌয়াল, কাঠুরের রান্নাবান্না ও খাওয়ার পানির ভরসা বনের গহীনের এই পুকুরগুলো। গত ২৬ মে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে স্মরণকালের সর্বোচ্চ জলোচ্ছ্বাস ও স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৮ ফুট পানি বৃদ্ধিতে এসব পুকুর ডুবে লোনা পানিতে এশাাকার হয়ে যায়।
প্রাকৃতিক নিরাপত্তাপ্রাচীর সুন্দরবনের ভূমি ঘুর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের লোনা পানির নীচে তলিয়ে ছিল অন্তত দুই-তিন ঘণ্টা। পানিতে তলিয়ে থাকায় বিপন্ন হয়েছিল স্থলভূমির বন্যপ্রাণী। বিশেষ করে বনের হরিণ ছিলো সবচেয়ে বেশি বিপদে। জরুরি বিপদের বার্তা পেয়ে বন থেকে ফেরা বনজীবীরা জানান, প্লাবনের সময় জীবন বাঁচাতে দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করে বনের হরিণ। একই রকম আচরণ ছিলো বানরসহ আরো অন্যান্য প্রাণীদের ভিতর।
এছাড়া সুন্দরবন পশ্চিমবন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর একমাত্র সুপেয় পানির উৎস ছিল মিঠা পানির পুকুর। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পশ্চিম সুন্দরবনের ৫৪টি সুপেয় পানির পুকুরের মধ্যে ৫৩টি ডুবে ছিলো। সাতক্ষীরা রেঞ্জে মাত্র একটি পুকুরে পানি ঢোকেনি। প্রবল বাতাসে প্রায় ১১টির বেশী জেটি ভেঙে গেছে। জেটি থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার প্রায় ৩০টির মতো মাটির রাস্তা জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ধুয়ে গেছে। সুন্দরবন পশ্চিমবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস-জোয়ারের পানিতে বেশ কিছু ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কোথাও ৭ ফুট কোথাও ৮ ফুট বেশি জোয়ারের পানি উঠে। পশ্চিম সুন্দরবনে কোন বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে লোকালয়ে ভেসে আসা একটি চিতল হরিণের বাচ্চা চুনকুড়ি নদীতে ভেসে আসলে মরগাং বন টহল ফাঁড়ির কর্মকর্তারা খবর পেয়ে হরিণটি অবমুক্ত করে সুন্দরবনে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে গাছ-গাছালির ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। ৫৪টি মিঠা পানির পুকুরের মধ্যে ৫৩ টিতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লবণ পানি প্রবেশ করেছে।
এতে বন্যপ্রাণী ও বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুপেয় পানির ব্যাপক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী হরিণসহ বন্যপ্রাণীরা সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতো এসব পুকুর থেকে। সুন্দরবনের মিঠু পানির পুকুর ডুবে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, মানুষের যেমন তৃষ্ণা-পিপাসা পায়, তেমনি বন্য প্রাণীদেরও পানির পিপাসা পায়। বন্যপ্রাণীরা ওখানে লবণের জায়গায় বাস করলেও তারা কিন্তু মিষ্টি পানি পান করে। ফলে এখন সুন্দরবনে যে বন্যপ্রাণী তৃষ্ণায় বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানি পান করবে। এতে দেখা যাবে তাদের নানা ধরনের শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটবে। কারো কারো পেটের পীড়া হবে। এই সব প্রাণী তাদের বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা তৈরি হবে। আমরা যেহেতু এগুলো মনিটরিং করি না তাই এগুলো বুঝতে পারি না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবন চক্র এবং তাদের শরীরবৃত্ত যেটাকে বলে তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং অনেক প্রাণী রোগাক্রান্ত হবে এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রজনন থেকে শুরু করে শরীর বৃত্তীয় নানা কর্মকা-ে পরিবর্তন তৈরি হবে। মারাও যেতে পারে কিছু প্রাণী। যখন গহীন বনে বন্যপ্রাণী মারা যায় সেগুলো স্বাভাবিকভাবে মানুষ বুঝতে পারে না।
অনেক সময় তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে অসুস্থতার যে অস্থিরতার কারণে হয়তো অনেক সময় আশপাশে চলে আসে বা জেলেরা বা মৌয়ালীদের চোখে পড়লে সেগুলো সনাক্ত হয়। কিন্তু গভীর বনে যেগুলো মারা যায় এগুলো বেশিরভাগই সময় সনাক্ত হয় না। ফলে দেখা যায় এই লবণপানি পান করার কারণে ছোট যে হরিণ সাবক আছে বা ছোট যেসব প্রাণী আছে তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুন্দরবনের মিঠা পুকুরে যে লবণ পানি প্রবেশ করেছে তা থেকে উত্তরণের বিষয়ে কোনো পরামর্শ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে লবণ পানি তুলে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে লবণ পানি তুলে ফেলে এখন বৃষ্টি পানি দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। যে পানি ঢুকেছে জোয়ারের পানি চলে গেলে আস্তে আস্তে বৃষ্টির পানিতে লবণাক্ততা কমে আসবে এবং প্রাণীরা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।
খুলনা টাইমস/এমআইআর