সংকট কাটছে না ফারমার্স ব্যাংকেরঃদেনা শোধেই সরকারি টাকা শেষ

0
369

খুলনাটাইমস ডেস্কঃরাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক সংকট এখনও কাটেনি। পরিচালনায় নতুন নেতৃত্ব আনা হলেও আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি। আগের দেনা পরিশোধেই সরকারি ব্যাংকের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আর্থিক সংকট কাটছে না ব্যাংকটির।ফারমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন আমানত না আসার কারণে এখনও ব্যাংকটি সীমিত আকারে লেনদেন করছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়ায় সরকার ব্যাংকটি বন্ধ করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত না নিয়ে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠান মিলে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৭১৫ কোটি টাকা পাওয়া গেলেও এখনও সমস্যা কাটেনি। বাধ্য হয়েই সীমিত আকারে লেনদেন করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাংকটিতে আর্থিক সংকট প্রকট ছিল। এখন যে টাকা আসছে, তা দিয়ে সামাল দিতে দিতেই টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবে আগের চেয়ে চাপ কমেছে। তিনি বলেন, বন্ড বিক্রি করে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার যে পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে, সেটা বাস্তবায়িত হলে চাপ আরও কমে যাবে।
এদিকে ব্যাংকটি বন্ড ছেড়ে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেও কোনও বেসরকারি ব্যাংক এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকটির বন্ড কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এবং সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবিকে। অবশ্য এর আগে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে এক হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই দফায় ৫০০ কোটি টাকা করে বাজার থেকে এ অর্থ সংগ্রহ করবে ব্যাংকটি। ইতোমধ্যে চার ব্যাংক ও আইসিবির কাছে বন্ড বিক্রির প্রস্তাব পাঠিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংক উদ্ধার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা ১৬৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছি। এছাড়া ব্যাংকটির কাছে মেয়াদি আমানত (এফডিআর) ও কলমানি (আন্তঃব্যাংক ঋণ) হিসেবে আমাদের ১৫০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। এর বাইরে আরও ১০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছি। মূলধন জোগান দেওয়ার মাধ্যমে এখন আমরাও ফারমার্স ব্যাংকের অংশীজন।

জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে ফারমার্স ব্যাংকে ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ পাঁচ প্রতিষ্ঠান। নতুন করে জোগান দেওয়া মূলধন যুক্ত হয়ে ফারমার্স ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ১১৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং রূপালী ব্যাংক ১৬৫ কোটি টাকা করে মূলধন জোগান দেয়। আইসিবিকে দিতে হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। যদিও প্রতিষ্ঠালগ্নেই আইসিবি ৬০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছিল। এর বাইরে ফারমার্স ব্যাংককে ধার দেওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত এ চার ব্যাংকের প্রায় ৫৫০ কোটি টাকাও আটকে আছে। এরমধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের ১৫০ কোটি ও জনতা ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠানের এমডিরা ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদের সদস্য হলেও রাতারাতি ব্যাংকটি ওপরে তোলা সম্ভব নয়। বিষয়টি এমন নয় যে আমরা ব্যাংকে গেলাম বলেই ব্যাংকের উন্নতি হয়ে গেল।’ তিনি বলেন, ‘এই ধরনের ব্যাংকে হঠাৎ করে উন্নতি হবে এমনটি আশা করাও যায় না। সবেমাত্র আমরা দুটি বোর্ড সভা করেছি। এখন আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি ব্যাংকের কোথায় কী আছে। কোথায় সমস্যা আর কোথায় কতটুকু কী করা যায়। তবে সরকার যেহেতু ব্যাংকটিকে টেকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু ব্যাংকটি টিকে যাবে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠান যেহেতু ব্যাংকটির পর্ষদে এসেছে, সেহেতু মানুষের আস্থা বাড়বে। ব্যাংকটিতে যে সংকট ছিল, তা মোকাবিলা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ফারমার্স ব্যাংকের আমানত ছিল ৪ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে ৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা। আমানতের চেয়ে ১৭১ কোটি টাকা বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাংকটিতে এখন খেলাপি ঋণ ৯৬৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৯ শতাংশ। বিপর্যস্ত ব্যাংকটি ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে সরকারি ব্যাংকগুলো যে টাকা ঢালছে, তা ফিরে আসবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রতিনিধিরা নিজেদের ব্যাংক চালাবে নাকি বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংক চালাবে?’
তিনি বলেন, অনিয়ম বন্ধ করে বিতরণ করা ঋণগুলো আদায় করা গেলে বেশি উপকার হতো। এছাড়া ব্যাংকটিকে ছোট করে আনার মধ্য দিয়েও সমস্যার সমাধান হতো।এদিকে ফারমার্স ব্যাংকের আগের সব পরিচালককে পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটির শীর্ষ নেতৃত্বে বসানো হয়েছে নতুন মুখ। ফার্স্ট জনতা ব্যাংক মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি চৌধুরী নাফিজ সরাফতকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ ব্যবস্থাপনা পরিচালকও রয়েছেন ব্যাংকটির পর্ষদে। ফলে ব্যাংকটি এখন পরিচালিত হচ্ছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব-পিপিপি) ভিত্তিতে। ব্যাংকটিতে সরকারের শেয়ার রয়েছে ৬৪ শতাংশ। আর বেসরকারি উদ্যোক্তাদের শেয়ার রয়েছে ৩৬ শতাংশ। ব্যাংকটির অন্য পরিচালকরা হলেন, ইবিএল এনআরবি মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি হাসান তাহের ইমাম, সোনালী ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, জনতা ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ, অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. শামস-উল-ইসলাম, রূপালী ব্যাংকের প্রতিনিধি মো. আতাউর রহমান প্রধান, আইসিবির প্রতিনিধি কাজী সানাউল হক, ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতিনিধি মো. আবু কায়সার, ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ডের প্রতিনিধি তামিম মারজান হুদা।
গত বছরের শেষের দিকে ফারমার্স ব্যাংকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৭ নভেম্বর ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। একই দিন ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ব্যাংকের এমডি একেএম শামীমকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
৪০১ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে ফারমার্স ব্যাংক। ওই সময় ৩৯ জন ব্যক্তি-উদ্যোক্তার বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৯৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ছিল ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক ৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল ফারমার্স ব্যাংকে।