র‌্যাবের প্রচেষ্টা ও সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ানের মধ্যস্থতায় দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা

0
799

মো:জসিম উদ্দিন : চলতি বছরের অক্টোবর মাসেই দস্যুমুক্ত ঘোষণা হতে যাচ্ছে প্রিয় সুন্দরবন। এতে সুন্দরবনকে ঘিরে জীবীকা নির্বাহকারী লাখ লাখ বনজীবী এবং দেশ বিদেশের ভ্রমন পিপাসুরা সস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান করে নেয়া প্রিয় সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে সরকারের ক্ষমাসুলভ দৃষ্টি, র‌্যাবের জোরালো উদ্যোগ ও জীবনের ঝুকি নিয়ে মধ্যস্থতাকারী ঢাকা টাইমস খুলনার প্রতিনিধি সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ানের কৃতিত্ব চোখে পড়ার মতো। তার বিশ্বস্ত মধ্যস্থতায় র‌্যাবের কাছে এ পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে ৫৭জন বনদস্যু। প্রক্রিয়ায় রয়েছে সুন্দরবনে থাকা শেষ ২/৩টি বাহিনীর সদস্যরাও।
সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ানের সাথে কথা বলে জানা গেছে অনেক অজানা কাহিনী। সুন্দরনে দস্যু মুক্ত করার প্রক্রিয়াটি সহজ ছিল না। একদিকে অবিশ্বাস আর অনাস্থার দোলাচল। অন্যদিকে জীবনের ঝুঁিক সবসময় তারা করেছে তাকে। অচেনা মানুষ আর অজানা স্থান থেকে ফোন পেয়ে দিনরাত তাকে ছুটতে হয়েছে গহীন থেকে গহীনতর বনে।
নিজের সাথে যুক্ত করেছেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টি ফোর’র টিম আন্ডার কাভারকে। প্রায় ৬মাসের মধ্যে সুন্দরবনের কুখ্যাত দাদাভাই বাহিনী, হান্নান বাহিনী ও আমির আলী বাহিনীসহ ৬টি বাহিনীর মোট ৫৭ জন বনদস্যু ষরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরেছে স্বাভাবিক জীবনে। র‌্যাব-৬ এর মাধ্যমে বিরাট এ কাজ সম্পন্ন করেছে সাংবদিক সোহাগ দেওয়ান।
কিন্তু কীভাবে এটি সম্ভব হলো? এ প্রসঙ্গে সোহাগ বলেন, ‘কখনও ভাবিনি গহীন সুন্দরবনের অভ্যন্তরে দুর্ধষ বনদস্যুদের কাছাকাছি গিয়ে তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে পারব। তবুও কৌতুহল পিছু ছাড়েনি আমার।’দিনটি ছিল চলতি বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি।
র‌্যাব-৬’র পক্ষ থেকে জানানো হয় সুন্দরবনের বনদস্যু দাদাভাই ওরফে রাজন বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে, আপনার সহযোগিতা চায় তারা’ ‘আমি প্রথমে অবাক হয়ে কথা শুনছিলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাজী হলাম। তখন বুঝতে পারছিলাম আমার সামনে বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ এসেছে। র‌্যাব-৬ থেকে আরও জানানো হয়, বনদস্যুরা সাংবাদিকের উপস্থিতি ছাড়া আত্মসমর্পণে সাহস পাচ্ছে না। তাদের মধ্যে ভয়, কাজ করে। বললাম হ্যাঁ আমি পারব, তবে দুই/ তিন দিন সময় চাইলাম।’
কীভাবে এই সমঝোতা হলো, সেটিও জানান সোহাগ। বলেন, ‘আমি বিষয়টি নিয়ে প্রথমে পরিচিত র‌্যাব-৬ এর স্পেশাল কোম্পানির ডিএডি জিয়াউল করিমের সাথে। তিনি প্রথমবারেই আমার আরও সাহস বাড়িয়ে দিলেন। তিনি এবিষয়টি নিয়ে সিনিয়র ডিএডি কামরুল ইসলামও আমাকে সাথে নিয়ে স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার এনায়েত হোসেন মান্নানের সাথে আলোচনা করেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে পর্যায়ক্রমে র‌্যাব-৬’ অধিনায়কের সাথে আলোচনা হয়।’ ‘সকলেই এই উদ্যোগের জন্য সাহস যুগিয়েছেন এবং সামনে এগিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। এরপর যোগাযোগ শুরু করি সুন্দরবনের বনদস্যু দাদাভাই ওরফে রাজন বাহিনীর প্রধান জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজনের সাথে। প্রতিদিন একবার তার সাথে মোবাইল ফোনে কথা হতো নির্দিষ্ট সময়ে।’
সোহাগ জানান, গত ২ এপ্রিল সুন্দরবনের গহীনে দাদাভাই বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে রওয়ানা হন প্রথমবারেরমত রওনা হন । একটি ট্রলারে করে সুন্দরবনের আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতে পৌঁছেন ১৩ ঘণ্টা পর। সঙ্গে ছিলেন সেই মানুষটি যিনি তাকে এ কাজে আসার জন্য ফোন করেছিলেন। ‘অবশেষে সুন্দরবনের একটি সরু খালের ভেতরে ট্রলারটি প্রবেশ করানো হয়। সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ান বলেন “তখন থেকে আমার মধ্যে ভয় ও নানা ধরণের আজে-বাজে চিন্তা ভর করে।’ আধঘণ্টা পর খালের ভেতরে একটি ছোট ডিঙ্গি নৌকা নজরে আসে সোহাগের। মনে হচ্ছিল মাছ ধরা জেলে। সামনে আসতেই দুই জন হাফপ্যান্ট পরিহিত লোক হাতে বন্দুকসহ দেখতে পান তিনি। কোমরে ছিল বেল্টওয়ালা ছোট ব্যাগ।সোহাগ আঁচ করলেন, এরা বনদস্যু। তারাই সালাম দিলেন তাকে। কুশল বিনিময় শেষে ট্রলার ও ডিঙ্গি নৌকা আরও ১০ মিনিট সামনে এগোনোর পর আরও একটি ট্রলার আসে। তাতেও বেশ কয়েকজন মানুষ ছিল। এরপর বেরিয়ে আসেন বাহিনী প্রধান জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন ওরফে দাদা ভাই বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান জাকির হোসেনসহ ১০/১২ জন অস্ত্রধারী। সেখানে আপেল, আঙ্গুর ও বোতলজাত পানি দিয়ে আপ্যায়ন করে দস্যুরা। গহীন বনে কীভাবে এসব পাওয়া সম্ভব জানতে চান সোহাগ। বাহিনী প্রধান রাজন বলেন, ‘আমরা টাকা দিলে শহর থেকে সব কিছু চলে আসে। আমাদের এক লাখ টাকায় ৪০ হাজার টাকার মালামাল পাই। ৬০ হাজার টাকা বহনকারীসহ অন্যান্যরা খায়, তাতেও আমার খুশি।’এরপর শুরু হয় আলোচনা। দস্যুরা জানান, তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। সেখানে ছয় ঘণ্টা কাটিয়ে ফিরে আসেন খুলনা। এরপর সোহাগ আবার যান র‌্যাব-৬ এর স্পেশাল কমান্ডার এনায়েত হোসেন মান্নানের কাছে।
এরপর ৮ এপ্রিল আবার সুন্দরবন যাত্রা করেন সোহাগ দেওয়ান। বনে গিয়ে আমীর আলী ও হান্নান বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে লক্ষ্যে পৌঁছান। এরপর সেখান থেকে ফিরে আবার র‌্যাবের সঙ্গে কথা বলেন সোহাগ। জানান, সবাই আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত। স্থানীয় র‌্যাব কর্মকর্তারা এরপর যোগাযোগ করেন সদর দপ্তরে। আর সেখান থেকে তারিখ দেয়া হয় ২৩ মে।
সোহাগ বলেন, ‘আগের দিন সকাল ১১টায় রওয়ানা করে দুপুরে আবার সুন্দরবনে পৌঁছাই। তারাও কিছুটা এগিয়ে আসে। চাঁদপাই রেঞ্জের হারবাড়িয়া এলাকায় তাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়।’এরপর র‌্যাব-৬ এর একটি নৌযানে করে দস্যুদের অস্ত্রসহ নিয়ে আসা হয়। দীর্ঘদিনের দস্যুতার জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবনের প্রত্যয় নিয়ে খুলনার লবণচরাস্থ র‌্যাব-৬ কার্যালয়ে গত ২৩মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন ও র‌্যাব’র মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ’র কাছে অস্ত্র ও গোলা বারুদ জমা দিয়ে সুন্দরবনের ছয় কুখ্যাত জলদস্যু-বনদস্যু বাহিনীর ৫৭ সদস্য আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এসময় ৫৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১২৮৪রাউন্ড গুলি জমা দেয় বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা। সরকারের কাছে র‌্যাব-৬’র মাধ্যমে এসকল দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে কাজ করেছেন খুলনার সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ান।
সোহাগ বলেন, ‘প্রথমে ভয় লাগছিল। আসলে ওদের সঙ্গে কথা বলার পর বুঝলাম, ভয় আসলে তাদের। নানা কারণে তারা সুন্দরবনে যান। এর পেছনেও নানা নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনি আছে। তাই চিন্তা করলাম, এদেরকে সহযোগিতা করব।’
র‌্যাব-৬’র অধিনায়ক ইউং কমান্ডার হাসান ইমন আল রাজীব বলেন, সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার জন্য সর্বাত্বক চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা জলদস্যু-বনদস্যুমুক্ত হয়েছে। চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে সুন্দরবনকে পুরোপুরি দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা সম্ভব বলে জানান তিনি। পাশাপাশি তিনি বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের কাজে সহায়তাকারী সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ান ও নিউজ টোয়েন্টি ফোর টেলিভিশনের টিম আন্ডার কাভারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সুন্দরবনকে পুরোপুরি দস্যুমুক্ত করতে তারা সাংবাদিকদের সহযোগিতা পাবেন বলে আশা করেন।