মোঃ ইউনুছ আলী ইনু, বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিজয়ের স্বপ্ন গাঁথা ২৯ বছরের উদ্যমী যুবক। ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৯৬৪ সালে খুলনা পৌর ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, ৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক ও ৬৮ সালে জেলা সভাপতি নির্বাচিত হন। ৭৩’এ খুলনা যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। বৃহত্তর খুলনায় মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। মাগুরা ও কপিলমুনি যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। এখন তিনি বার্ধক্যে। নগর আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ী কমিটির উর্ধ্বতন সহ-সভাপতি।
কপিলমুণি যুদ্ধ জয়ের পূর্বের স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, ১৯৭১ সাল। নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের ঘটনা। কলিকাতায় অবস্থিত মুজিব বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে তোফায়েল আহম্মেদ স্বাক্ষরিত চিঠি পাই। চিঠিতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ক্যাম্প ক্লোজ করে নিয়ে আমাকে শহর অভিমুখে যেতে হবে। তখন সাতক্ষীরা তালা উপজেলায় মাগুরা ইউনিয়নের মাগুরা গ্রামে পীর সাহেবের বাড়িটি ছিল মুক্তি বাহিনীর হলটেস্ট প্লেস।
খুলনাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শত্র“ঘাটি ছিল কপিলমুণির রাজাকার ক্যাম্প। যাকে মিনি ক্যান্টনমেন্ট বলা হতো। এর পতন না ঘটিয়ে মাগুরা ত্যাগ করা যাবে না। এজন্য আমার ওপর এলাকাবাসীর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। কারণ এই ক্যাম্পে রাজাকারদের অত্যাচারে আশপাশের প্রায় ১৪’শ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এতেই তাদের নিষ্ঠুরতার কাহিনী ফুঁটে ওঠে।
এক পর্যায়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্যাম্পটাকে কিছু একটা করার দরকার। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক হেড কোয়ার্টারে হাজির হই। অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়ের লক্ষে। পাইকগাছার হাতিয়াডাঙ্গা গ্রামের এক পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতেই ছিল আঞ্চলিক হেড কোয়ার্টার। রহমতউল্লাহ দাদু, সম বাবর আলীসহ আরও কিছু নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করে কপিলমুণি রাজাকার ঘাঁটি পতনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আমার পরে ওই ক্যাম্প রেকি ( অনুসন্ধান) করার বিশেষ দায়িত্ব অর্পিত হয়। সম বাবর আলী ও আবুল কালাম আজাদ নিয়ে আমি ক্যাম্প রেকি করবার লক্ষে গন্তব্যস্থল মাগুরা গ্রামে চলে আসি। তখন মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। যে বাড়িতে অবস্থান করছি সেখানে আগুর জ্বলছে। এলাকাবাসীর কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম, তার আগের দিন আমাকে ধরার জন্য পাটকেলঘাটা থেকে রাজাকারদের সাথে নিয়ে খান সেনারা ওই বাড়িতে আক্রমণ করে। বাড়ির লোকজন ২/৩’শ গজ দূরে একটি পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাধ্য হয়ে আমিও সেখানে অবস্থান নেই।
এই বাড়িটির কাছাকাছি একটি ছোট্ট মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সেখানের দায়িত্বে ছিলেন নুরুজ্জামান মন্টু। সে এলাকার সার্বিক অবস্থা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করেন। নকশালদের কার্যকলাপ, রাজাকার ও খান সেনাদের তৎপরতাই ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। আলোচনার এক পর্যায়ে মন্টু জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়মিত ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ আহতবস্থায় আমাদের হাতে ধরা পড়েছে। সে এখানে অবস্থান করছে। তথ্য বিনিময়ের পর মন্টু তার অবস্থানে ফিরে যান।
আমরা প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সাইকেল চড়ে এক লোক এসে চিৎকার করে বলতে লাগল, ’স্যার বেরিয়ে আসুন, আপনাদেরকে আক্রমণ করছে।’ আমরা খানিকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। ক্ষুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। খান সেনারা রাতের বেলায় গ্রামের ভেতরে এসে আমাদেরকে আক্রমণ করবে। মিনিট খানেকের ভেতর শামসু মাষ্টার নামের আরেক মুক্তিযোদ্ধা একইভাবে চিৎকার করে বলতে লাগল, স্যার বেরিয়ে আসুন, আপনাদেরকে আক্রমণ করছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগে বিকট শব্দে দালানের কার্ণিসের একটি অংশ ভেঙে পড়ে। তখনই বুঝলাম আমরা আক্রান্ত হয়েছি। বাবর আলী ও কালামকে সাথে নিয়ে বাড়ির পশ্চিম পাশে অবস্থিত একটি কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে নেমে পড়ি। কচুরিপানার তল দিয়ে পুকুরের অপর প্রান্তে নাক ভাসিয়ে অবস্থান করি। ওরা বাড়ির ভেতর ঢুকে তন্ন তন্ন করে আমাদের খুজতে থাকে। না পেয়ে প্রচন্ড গোলাগুলি করতে থাকে। আমাদেরকে না পেয়ে গ্রামের সম্ভাব্য যেসব বাড়িতে অবস্থান করতে পারি, সেসব স্থানে তল্লাশি ও গোলাগুলি করে।
রাত ৯টা পর্যন্ত পুকুরে থেকেই আমরা প্রচন্ড গোলাগুলি শব্দ মুনতে পাই। ঘন্টা খানেক আর কোন গোলাগুলির শব্দ না পাওয়ায় রাত ১০টার দিকে পুকুর থেকে উঠে আসি। এসে দেখি আমাদের বিল্ডিংটি গোলাগুলিতে প্রচন্ড ক্ষয়খতি হয়েছে। এ দেখে অন্যান্য যেসব জায়গায় আক্রমণ হয়েছে, সেখানে রওয়ানা হই। প্রথমেই যাই ওই ছোট্ট ক্যাম্পটিতে। ক্যাম্পের সামনেই রাইফেল এবং এসএলআর হাতে সুশীল, বক্কার, আজিজ নামের ৩ মুক্তিযোদ্ধা মৃতবস্থায় পড়ে আছে।
ক্যাম্প প্রধান মন্টু তার কিছু দূরে ধান ক্ষেতের ভিতর আহতবস্থায় পড়ে আছে। মন্টুকে উদ্ধার করে হেড কোয়ার্টারে চিকিৎসার জন্য পাঠাই। ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশের একটি ঝোপের ভিতর থেকে অক্ষত অবস্থায় ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহকে উদ্ধার করি। রাতের মধ্যে সমস্ত জায়গা ঘুরে সুশীল, বক্কার, আজিজ, বিমল, ঝুনু বাবু, শান্তি বাবুসহ ১৪জন মৃত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হয়।
এছাড়া আফতাব সরদার নামে তালা থানা জামায়াতের আমীরকেও হত্যা করে রেখে যায়। অপরাধ ছিল তার ছেলে আব্দুর রউফ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল। আমরা তিনজন সেদিন কোন রকমে প্রাণে বেঁচে ছিলাম। এত প্রতিকুলতা স্বত্ত্বেও এক পর্যায়ে আমরা কপিলমুণি রাজাকার ক্যাম্প রেকি করতে সক্ষম হই। এবং ১৯৭১ সালের ৬ডিসেম্বর ক্যাম্পটি আক্রমণ করি। ৬২ ঘন্টা যুদ্ধের পরে ১৬০জন শত্র“কে আত্ম সমর্পনে বাধ্য করি। এভাবেই ইউনুস আলী ইনু বিজয়ের মাসের বর্ণনা দেন।