বিদ্যুতের প্রি-প্রেইড মিটার : বিড়ম্বনার নগর জীবন

0
826

কৌশিক দে:
প্রযুক্তি আশীর্বাদ, অনেক ক্ষেত্রে তা আবার যন্ত্রণা ও অভিশাপেরও হয়। আমরা খুলনা মহানগরের বাসিন্দারা এমনই এক বিড়ম্বনায় পড়েছি। এ বিড়ম্বনা থেকে আমাদের সহসা নিস্তার মিলছে না এক কথা যায়। এ বিড়ম্বনার নাম অত্যাধুনিক প্রি-প্রেইড মিটার। খুলনার প্রায় ৬০ হাজার গ্রাহক প্রি-প্রেইড কার্ড ক্রয়ে ভেন্ডিং স্টেশন ও ব্যাংক শাখা স্বল্পতা, নিত্য নতুন চার্জ কর্তণে সাধারণ গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত নাজেহাল হচ্ছেন। খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিভিশন লিমিটেড (ওজোপাডিকো)’র কর্মকর্তারা বলেছেন, মোবাইল রিচার্জের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিক্রয় ব্যবস্থা নিয়ে আসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেটি বাস্তবায়ন হলে কার্ডের জন্য সমস্যা হবে না। আর বিভিন্ন চার্জের টাকা কর্তনের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রীয় নানা সিদ্ধান্তে এমন বিপাকে নতুন কিছু নয়। বিদ্যুৎ সেক্টর নিয়ে এ সমস্যা বলে শেষ করা যাবেনা। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, মিটার পরিবর্তনসহ নানা পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। তারপরে লোডশেডিং তো আছেই। আর এখন নতুন আপদ প্রি-প্রেইড মিটার ব্যবস্থাপনা। অনেকেই ব্যাংকে দীর্ঘ লাইন দিয়ে বিদ্যুৎবিল জমা দেয়ার বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা এখন মানুষ মানুষের কর্মঘন্টা নষ্ট করে সেই জায়গায় নিয়ে এসেছে। তাই বলছিলাম এ এক নয়া আপদ। তারপরও রয়েছে না রঙÑঢংয়ে চার্জ কর্তন। আমি গত ৩০ জুলাই ৫০০টাকা কার্ড কিনে বিদ্যুৎ (এনার্জি কস্ট) পেয়েছি ৪৫১ টাকা ১৯ পয়সার। এরমধ্যে সার্ভিস চার্জ নেয়া হয় ১০ টাকা, ডিমান্ড চার্জ ১৫ টাকা ও ১৫% ভ্যাট বাবদ ২৩. ৮১টাকা। ১৬ আগস্ট ১ হাজার টাকার কার্ডে বিদ্যুৎ মেলে ৯২৭.৩৮টাকার। এখানে বাকী টাকা ভ্যাট, সার্ভিস ও ডিমান্ড চার্জে কেটে নেয়া হয়। তবে ১৩ সেপ্টেম্বর এক হাজার কার্ডে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় ৮৮৭.৩৮ টাকার। এখানে ভ্যাট,সার্ভিস ও ডিমান্ড চার্জ ছাড়াও কোন ঘোষণা ছাড়া আরও ৪০টাকা কেটে নেয়া হয়। দৌলতপুরের আড়ংঘাটা এলাকার বাসিন্দা অলোকেশ হালদার একইভাবে বলেন, তিনি ৫শ’ টাকার কার্ডে পেয়েছেন ৪১১ টাকা ১৯ পয়সা। ডিভিশন-৪ এর গ্রাহক খলিল চেম্বার প্রসেনজিৎ ৫শ’ টাকার রিটার্জ কার্ডে পানস ৩২৬ টাকা ১৯ পয়সা। তার ১৭৩ টাকার বেশি কেটে নেয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগী মানুষের অভিমত, আমরা তো বিদ্যুৎ বিভাগের জিম্মি হয়ে গেছি। মিটারের ফ্রি’তে দেয়ার কথা বলে এখন ভাড়া বাবদ ৪০ টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে। আর কত দিন টাকা কাটা হবে তা স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছেনা। প্রি-প্রেইড মিটার গলার ফাঁস হয়ে গেছে। কার্ড কিনতে ঝামেলা, বাড়তি টাকা কাটা- আমরা এ থেকে মুক্তি চাই।
সাংবাদিকদের কাছে ওজোপাডিকোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনার চারটি বিতরণ বিভাগে বর্তমানে এক লাখ ৮৩ হাজার ৪৭৭ জন গ্রাহক রয়েছে। বর্তমানে প্রি-প্রেইড মিটারের আওতায় এসেছে ৫৬ হাজার ৮৭৪জন। আরো ৮ হাজারসহ মোট ৬৮ হাজার গ্রাহককে এ প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। আর বাকী গ্রাহকদের পরবর্তী প্রকল্পে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনা হবে। আর ৬০ সহ¯্রাধিক গ্রাহকদের মিটারের কার্ড রিচার্জের জন্য নগরীর হাজী মহসিন রোড, টুটপাড়া, শেখপাড়া, পূর্ব বানিয়াখামার, শেরে বাংলা রোড, দৌলতপুর বিদ্যুৎ অফিস, খালিশপুর নেভি চেকপোস্টসহ ১২টি ভেন্ডিং স্টেশন ও বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের ৯টি শাখা রয়েছে। অতিরিক্ত টাকা কর্তনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ কার্ড কিনতে গ্রাহকদের ভোগান্তির শেষ নেই।
বিদ্যুত বিভাগের দাবি, গত ৭ মে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের আলোকে সিঙ্গেল ফেজ মিটারের মাসিক ভাড়া ৪০ টাকা ও থ্রি-ফেজ মিটারের মাসিক ভাড়া ২৫০ টাকা হিসেবে বিদ্যুৎ বিলের সাথে আদায় করা হচ্ছে। ওজোপাডিকো’র প্রি-প্রেমেন্ট মিটারিং প্রকল্পের পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তোফাজ্জেল হোসেনও সাংবাদিকদের বলেন, প্রি-প্রেইড মিটারে অতিরিক্ত টাকা কাটার সুযোগ নেই। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মিটার ভাড়া কাটা হচ্ছে। কার্ড রিচার্জের ক্ষেত্রে মোবাইল রিচার্জের মত সুবিধার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রামীণ ফোনের সাথে চুক্তি স্বার করা হয়েছে। অচিরেই গ্রাহকরা ঘরে বসে রিচার্জ করতে পারবে।
সে যাই হোক, প্রি-প্রেইড মিটারে নানা সুবিধার বিষয় উল্লেখ করে বছর কয়েক আগে সাংবাদিক হিসেবে আমি নিজেও প্রতিবেদন করেছি। তখন নগরীর হাজী মহসিন রোড এলাকা ছিল ‘পাইলট প্রকল্প’। কয়েক বছরে সেটি বিস্তৃত লাভ করেছে। আশা করেছিলাম বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ হয়তো ওই প্রকল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রকল্পে কাজ করবেন। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে মানুষ এখন ব্যস্ত সময় অতিক্রম করে। রুটি-রুজির তাগিয়ে সারাক্ষণ ছুটে চলতে হয়। তাই কয়েকটি কর্মঘন্টা নষ্ট করে তার পক্ষে বিদ্যুতে প্রি-প্রেইড কার্ড কেনা অনেকটাই কষ্টের। আর কোন ধরণের ঘোষণা ছাড়া যেনতেন নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা সামিল। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুটে নেয়া কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
মহানগরীতে বৃহৎ আকারে প্রি-প্রেইড (প্রি-প্রেমেন্ট) প্রকল্প বাস্তবায়নের জনগণের এসব সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ওজোপাডিকোর বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল। তাতে করে সাধারণ মানুষের উত্তম সেবা পেতেন; তারা ক্ষুব্ধ হতেন না। বরং অবস্থাটা এখন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ এর মতো দাড়িয়েছে। আমরা এ অবস্থা থেকে রেহাই চাই।
লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ, খুলনা ব্যুরো।