মীর খায়রুল আলম,দেবহাটা:
সাতক্ষীরার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা দেবহাটা। ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছোট্ট উপজেলাতে ছিল অসংখ্য নির্দশনে ভরপুর। উপজেলার অবস্থান ভেদে পূর্বে আশাশুনি উপজেলা, পশ্চিমে ভারত-বাংলা ইছামতি সীমান্ত, উত্তরে সাতক্ষীরা সদর এবং দক্ষিণে কালিগঞ্জ উপজেলা অবস্থান। প্রায় ১৫০ বছর আগে দেবহাটার টাউনশ্রীপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো দেবহাটা পৌরসভা। এই গ্রামে ছিল ১৮
জমিদারের বসবাস। কিন্তু কালের বিবর্তনে সব কিছু হারিয়ে গেছে। সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ইছামতি নদীর তীরঘেসা গ্রাঁমটির নাম টাউনশ্রীপুর। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জন্মের আগেই ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ সালে দেবহাটাকে পৌরসভা ঘোষণা করে।
আর এই পৌরসভার কার্যালয় ছিল দেবহাটার টাউনশ্রীপুর গ্রামে। ওই সময় বিভাগীয় শহর খুলনাতেও পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রবীনদের মতে পাকিস্থান সরকার সম্ভবত ১৯৫০-১৯৫১ সালে টাউন শ্রীপুর পৌরসভা বিলুপ্ত ঘোষনা করে। পাকিস্তান সরকারের এ সিধান্তের বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ে রাওয়ালপিন্ডি হাই হাইকোর্টে
মামলা করেছিলেন জমিদার অনীল স্বর্ণকার। কিন্তু দেবহাটা টাউন শ্রীপুরে আর পৌরসভা ফিরে আসেনি। সেই সময় পার করে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় দেবহাটা উপজেলা। এরপর থেকে পরিবর্তনের ছোয়া লাগলেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি।
কিন্তু আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশব্যাপী যে পরিবর্তন ঘটে তার একটি অংশের ছোয়া লাগে দেবহাটায়। আর উন্নয়নের ছোয়া লাগাতে দক্ষ ও রুচিশীল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নের্তৃত্বে গোটা উপজেলার রূপরেখা
পরিবর্তন হয়ে সর্বত্র এর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হাফিজ-আল-আসাদ ২০১৭ সালের ১১.০১.২০১৭ তারিখে তথা জানুয়ারি মাসে দেবহাটায় যোগদান করেন। তার যোগদানের পর নিজস্ব রুচি আর
সৃজনশীল ব্যক্তিত্বে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। যার ফলে উপজেলাটি হয়ে উঠেছে একটি দৃষ্টিনন্দিত ও আকর্ষণীয়। পরিবর্তন নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হাফিজ আল-আসাদ এর সাথে কথা বললে জানা যায়, চাকুরীর শুরুতে
২০১১ সালে পটুয়াখালী জেলাতে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
পর্যায়ক্রমে দেবহাটায় যোগদান করে বিভিন্ন স্থানে এনেছেন দৃশ্যমান পরিবর্তন। জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মোঃ মহিউদ্দিন’র দিকনির্দেশনায় এবং
তার ব্যক্তি উদ্যোগে সরকারের স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে কাজ করে যাচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন উন্নয়নের বাজেটের বরাদ্ধকৃত অর্থ এবং উপজেলা পরিষদের সার্বিক সহযোগীতায় পরিবর্তন এনে সু-সজ্জিত করেছেন। ২০১৭ সালের
পূর্বে দেবহাটা উপজেলার গেইট নির্মান করা সম্ভব হয়নি। সেটি আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অংশ ৯নং সেক্টরের অধীনে ছিল দেবহাটা। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে দেবহাটা উপজেলা পরিষদের পুকুরের পাশবর্তী স্থানে তৈরী করা হয়েছে একটি মুক্তমঞ্চ। উপজেলা পরিষদ চত্তরকে সৌন্দর্য্য মন্ডিত করতে এসএস পাইপ দিয়ে চমৎকার ফুলের বাগান তৈরী
করা হয়েছে। শুধু ফুলের বাগান নয় সাথে তৈরী করা হয়েছে ঔষধি বাগান, যাতে রয়েছে ১৮৮ ধরনের ঔষধি বৃক্ষ। প্রত্যেকটি গাছের সাথে তার নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম লিখে দেয়া হয়েছে এবং এ বাগানের এক পাশে ১২২ ধরনের টক জাতীয় গাছ
লাগানো হয়েছে। উপজেলার ভূমি অফিসে সেবা গ্রহীতাদের বসার স্থান (কাছারি ঘর) নির্মান হয়েছে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। বর্তমানে সেবা গ্রহীতারা
সেটি ব্যবহার করছে। সরকারের স্বপ্ন, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে উপজেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ১০টি ভ্যান, ০৪ টি দোকান, ওজন মাপার মেশিন, সেলাই মেশিন, ৬টি গরু, ৩০টি ছাগল প্রদান এবং একজন ০৬ জন আশ্রয়হীন ভিক্ষুককে এক কক্ষ বিশিষ্ট ঘর নির্মান সম্পন্ন করা হয়েছে। ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার ০২ কক্ষ বিশিষ্ট পাকা গৃহ নির্মান করে দিয়েছেন। উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এবং সেবাগ্রহীতাদের জন্য প্রথম পাঁকা সাইকেল ও মোটরসাইকেল সেড নির্মান হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিস ও উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাজিরা প্রদানের জন্য ডিজিটাল হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদে সেবা গ্রহীতাদের জন্য ডিজিটাল সেন্টার
স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। উপজেলা পরিষদে শিশু পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে।
শিশুদের বিনোদন প্রদানের লক্ষ্যে যেখানে শিশুদের জন্য ব্যালান্স, দোলনা, সিলিপারসহ ইত্যাদি রয়েছে। সরকারি কর্মজীবী নারীদের বাচ্চাদের জন্য উপজেলা পরিষদে ডে-কেয়ার সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে আধুনিকায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শ্রেণি কক্ষে মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি নতুন যোগ হয়েছে ডিজিটাল হাজিরার ব্যবস্থা। যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজিরা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি উপস্থিতর সংখ্যা বাড়াতে সাহায্যে করছে। সেই সাথে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা কমিয়ে উপস্থিতির সংখ্যা বাড়াচ্ছে। পাঠদান ও সহজ
পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ২৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন এবং ৬০ প্রাথমিক বিদ্যলয়ে ১৯ ইঞ্চি মনিটর, ১৬জিবি পেনড্রাইভ প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রথামিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি মোবাইলে এবং বছরের প্রথম দিন শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। এদিকে, প্রচীনতম দেবহাটার উপজেলা সীমানা নির্ধারণ পুষ্পকাটি টু বেজর আটিতে দেবহাটা উপজেলার সীমানা নির্ধারক পিলার, সখিপুর মোড়ে দেবহাটা উপজেলা পরিষদের অবস্থানের চিহ্ন নির্দেশক তথা
ইনডিকেটর নির্মাাণ করা হয়েছে। উপজেলার প্রতিটি দপ্তর ও উপজেলা চত্বরে সিসি ক্যামেরা এবং ইন্টারকম স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। সাথে সাথে দেবহাটা উপজেলার দর্শনীয় স্থান রুপসী দেবহাটা
ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্র ও বনবিবির বটবৃক্ষ ঘিরে রয়েছে নানামূখি উদ্যোগ। তবে, ইতোমধ্যে ইছামতির তীরে গড়ে তোলা ম্যানগ্রোভ মিনি সুন্দরবনকে
পরিপূর্ণরূপে সাজাতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড চলমান রয়েছে। যার মধ্যে যাওয়া আসার জন্য ২টি ট্রেইল তৈরীর কাজ শেষ হয়েছে। নতুন বছরের শুরুতে আরো নির্মান কাজ শুরু হবে। দর্শনার্থীদের পর্যটন কেন্দ্রটির বিভিন্ন স্থানে বসার জন্য পাঁকা বেঞ্চ তৈরী করাসহ পর্যটকদের বনের ভেতরে হাঁটার জন্য বাঁশ দিয়ে ট্রেইল তৈরীর কাজ চলমান রয়েছে। পর্যাটন কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ ও সোলার প্যানেল সংযোগ দেওয়া হয়েছে। একই সাথে পর্যটন কেন্দ্রটির পুকুরে পর্যটকদের জন্য একটি প্যাডেল নৌকা নামানো হয়েছে। যা পর্যটন কেন্দ্রটির সৌন্দর্যের নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং পর্যটকরা বেশ আগ্রহের সাথে উপভোগ করছেন। নতুন
ট্রেইলের কাজ ও প্যাডেল নৌকার কারনে দুরদুরান্ত থেকে পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দিকনির্দেশনায়
রিসোর্স সেন্টারের প্রশিক্ষণ কক্ষ সজ্জিতকরণ, প্রশিক্ষণ গ্রহনকারীদের জন্য মনোরম পরিবেশ, বিভিন্ন সৃষ্টিশীল ছবি ও হস্তশিল্পের সংযোজন, সীমানা প্রাচীর, গেইট, শিক্ষকদের জন্য গোলচত্তর স্থাপন, সাইকেল ও মোটরসাইকেল সেড নির্মাণ, নামাজের ঘর নির্মাণ, রাতে আলোকসজ্জা, সৌন্দয্যবর্ধক বিভিন্ন কর্মকান্ড, প্রাচীর ও দেয়ালে মহান ব্যক্তিদের বানী, ক্যাম্পাসে ফুলের বাগান ইত্যাদি তৈরী সম্পন্ন এবং অসংখ্য কর্মকান্ড চলমান হয়েছে। তাছাড়া, উপজেলার বসবাসরতদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সপ্তাহের একদিন গনমুনানির ব্যাবস্থা করেন তিনি। এপর্যন্ত যার সংখ্যা ৯০ টি। পাশাপাশি যোগদানের সময় থেকে ৭৪ টি মোবাইল কোর্ট করা হয়েছে, যার মধ্যে মাদক, জুয়া, নাশকতা, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রতিরোধে ৫৭ টি। তাছাড়া বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক বিরাজ করছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরো বলেন, জেলার সবকটি উপজেলায় বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। কিন্তু দেবহাটায় না থাকায় অতিদ্রুত সেটিও চালু করা হবে। একই সাথে দেবহাটার বটবৃক্ষ (বনবিবিতলা) ও ম্যানগ্রোভ পর্যটন কেন্দ্রকে দর্শকদের মনে স্থান করে নিতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। উপজেলার শিক্ষা, চিকিৎসা, মৎস্য, কৃষিতে
ব্যাপক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। তার নিজস্ব চিন্তা চেতনা স্বরূপ দেবহাটা উপজেলায় একটি হোমিও প্যাথিক কলেজ এবং অসহায়, দরিদ্র, আশ্রয়হীন এবং সহায় সম্বহীন ভিক্ষুকদেও জন্য আনন্দ আশ্রম গড়ে তুলতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এদিকে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দক্ষ কর্ম প্রচেষ্টায় বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ছোয়াতে দেবহাটার পরিবর্তনে বর্তমান
সরকার ও ইউএনও কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।