নৌকাবাইচ কয়রার সমৃদ্ধ লোকজ ঐতিহ্য : উত্তরোত্তর অগ্রগতিই মূল চ্যালেঞ্জ

0
1426

আশিকুজ্জামান:
খুলনা নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে ও গ্রামীণফোনের সহযোগিতায় খুলনার রুপসা নদীতে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কয়রার “সুন্দরবন টাইগার”। ঢাকাস্থ কয়রা সমিতি’র স্মরণিকায় (বন্ধন) “নৌকা বাইচ : আমাদের প্রাণের লোকজ ঐতিহ্য” শিরোনামে কয়রার নৌকা বাইচের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তবে তার তথ্য সংগ্রহ করতে অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে।

১৯৮৬ সালের গোড়ার দিকে কয়রায় নৌকাবাইচের যে গোড়াপত্তন শুরু হয়ে আজ অবধি টিকে আছে। যার নাই কোন ছবি বা কোন লিপিবদ্ধ ইতিহাস। তৎকালীন গোড়াপত্তনের সাথে যেসকল প্রবীণ সমাজসেবীরা জড়িত ছিলেন তাদের আজ অনেকেই বেঁচে নেই।

কয়রার চার ইউনিয়নের (কয়রা সদর, মহেশ্বরীপুর, মহারাজপুর, দক্ষিণ বেদকাশী) সাতটি নৌকা মেঘদূত, বিদ্যুৎ, সুন্দরবন টাইগার, পঙ্খিরাজ, টাইগার নামধারণ করে বহুবছর ধরে খুলনাসহ পার্শ্ববর্তী জেলায় আয়োজিত নৌকা বাইচের অংশগ্রহণ করে আসছে, আসছিলো গৌরবের সাথে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক নৌকা আজ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সুন্দরবন টাইগার আর মেঘদূত নৌকা দুটি এখনও স্বগৌরবে কয়রার জলক্রীড়ামূলক এ শিল্প ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে।

এবারের খুলনার নৌকা বাইচে যোগ দিতে আসা সুন্দরবন টাইগারের কর্ণাধার, একক পৃষ্ঠপোষক রফিকুল ইসলাম। তার সাথে কথা হয় শুক্রবার সন্ধ্যায়। প্রায় ১৩০ জনের বিশাল বহর নিয়ে দুটি নৌকা আর একটি ট্রলারসহ তিনি যাত্রা শুরু করেন খুলনার উদ্দেশ্যে।

১৯৮৬ সালে তৈরি ৮০ ফুট লম্বা কয়রার প্রথম নৌকা সদর ইউনিয়নের মেঘদূত জাতীয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা’য় ৫ বছর ধরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশনের আয়োজনে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতা।

বারবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া কয়রার মেঘদূত নজর কাড়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশনের। এই দুটি প্রতিষ্ঠান কয়রার মেঘদূত কে স্বপ্ন দেখায় “রোয়িং ওয়ার্ল্ডকাপে (নৌকাবাইচের বিশ্বকাপ) অংশ নিতে। নৌকাবাইচের বিশ্বকাপ এবছরের জুলাই মাসে সুইজারল্যান্ডের রোতসি ও লুক্রেন শহরে ৩০ টি দেশের অংশগ্রহণে সম্পন্ন হয় ২১ তম আসর। বহুজাতিক কোম্পানির স্পন্সরের নেয়ার সুযোগ থাকলেও নানান প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতার কারণে পিছিয়ে আসে মেঘদূত। নৌকাটির সূচনালগ্ন থেকে ৫ নং কয়রা গ্রামের (সদর ইউনিয়ন) এইচ. এম আক্কাচ আলী একক পৃষ্ঠপোষকতার ভার গ্রহণ করেন। মেঘদূত কে নতুন রুপ দিতে এবারের খুলনার নৌকাবাইচের অংশ নিতে পারেনি।

কয়রার মেঘদূত আর সুন্দরবন টাইগার কয়রার সুন্দরবন পাড়ের হাজার হাজার মানুষের আবেগের নাম। বিনাপারিশ্রমিকে এ নৌকা দুটির বৈঠা হাতে নেন সুন্দরবনের জেলে পেশার হতদরিদ্র মানুষেরা। নৌকা তৈরিতেও এসব মানুষের রয়েছে সিংহভাগ অবদান। ঘরে অবশিষ্ট থাকা রান্না করার জন্য চাল দিয়েও অনেক নারীর প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে এই লোকজ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে। বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রাইজ হিসেবে পেয়ে থাকে গরু, মহিষ, টেলিভিশন, মোটরসাইকেল, ফ্রিজ। অবাক করার বিষয় হলো ২০০৯ সালের আইলায় টেলিভিশন আর ফ্রিজ গুলো লোনা পানি স্পর্শ পেয়ে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। সহজেই অনুমেয় যে, প্রাইজ তাদের কাছে মূল্যহীন, গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ।
মোদ্দা কথা হলো, একক পৃষ্ঠপোষকতায় কোন অঞ্চলের লোকজ ঐতিহ্যকে ধরে রাখা অসম্ভব। দরকার এলাকার জনপ্রতিনিধি আর বিত্তশালীদের শুভদৃষ্টি। চলমান এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে দরকার সমন্বিত কার্যকরী উদ্যোগ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশীয় এই বৈচিত্রময় শিল্পকে তুলে ধরতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সুযোগ রয়েছে অন্যসব আয়োজনের মতো নৌকাবাইচের বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচিত করানোর। হয়ত এই স্বপ্ন নিয়ে আজও ঘুমাতে যায় সুন্দরবনের হতদরিদ্র জেলে পেশার নৌকাবাইচের বাইচালরা।
(লেখক- সংগঠক ও শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র ও শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, ঢাকাস্থ কয়রা সমিতি)।