নিজস্ব প্রতিবেদক:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ক্ষমতাসীনদের টার্গেট ফের ক্ষমতা। বিএনপিকে নানা কৌশলে কোণঠাসা করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কথা ভাবছে দলটি। ফের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে সব ধরনের চেষ্টা চালাবে তারা। ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন নেতাকর্মীরা। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। আগামী নির্বাচনে শক্ত লড়াই হবে- নেতাদের কাছে এমন বার্তাও দেয়া হয়েছে। দল গোছানোর পাশাপাশি বিএনপির সমালোচনাসহ সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড তুলে ধরে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছেন কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনের আগে তা আরও জোরদার করা হবে। অন্যদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা পেলে, তা যার অধীনেই হোক, এতে অংশ নিতে চায় বিএনপি। তাই সরকারকে বিভিন্নভাবে চাপে রেখে কীভাবে ন্যূনতম একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, সেদিকেই নজর দলটির।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সুষ্ঠু ভোট হলে তাদের জয় সুনিশ্চিত। কারণ, তাদের মূল ভরসার জায়গা দলটির নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক। নানাভাবে দল বিপর্যস্ত হলেও সারা দেশে ধানের শীষের সমর্থক কমেনি। এর সঙ্গে যারা আওয়ামী লীগ ও সরকারের কর্মকান্ড পছন্দ করেন না- এ ধরনের ‘নেগেটিভ’ ভোটও তাদের পক্ষেই যাবে। তাই ভোটাররা যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন, এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে চান তারা। সে লক্ষ্যেই সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিসহ নেয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। বিএনপির জনসমর্থনের বিষয়টি আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে।
নিয়ম অনুযায়ী সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের কাছাকাছি সময়ে। সেই হিসেবে পরবর্তী নির্বাচনের এখনো এক বছর ৮ মাস সময় হাতে রয়েছে। কিন্তু তারপরও আগাম সংসদ নির্বাচন নিয়ে যেন প্রধান দু’দলের আগ্রহ এবং প্রস্তুুতির নমুনা পরিস্কার হয়ে উঠছে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটে যেন অনেকটাই শুরু হয়েছে তোড়জোড়।
বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের নিজ নিজ এলাকা গিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরার আহবান জানিয়ে আসছেন। সেই সঙ্গে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন। এ থেকেই আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট নেতাকর্মীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সংকেত পেয়ে তৃণমূলে যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অপরদিকে সরকারি দলের কথাবার্তায় নির্বাচনী আভাস পেয়ে বিএনপি নতুন করে সোচ্চার হয়েছে। এজন্য নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার দাবিতে বিএনপি নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছেন। এ দাবিকে ইস্যুতে পরিণত করে উপযুক্ত সময়ে আন্দোলনের ছকও কষছে দলটি। আগাম নির্বাচন হলে অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন দল দুটির নীতিনির্ধারকরা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়- সম্মানজনক বিজয়কেই একাদশ সংসদ নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে দল দুটির শীর্ষ নেতারা।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধীদল বিএনপিতে উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলমান থাকলেও আগাম নির্বাচনে আগ্রহ এবং প্রস্তুতি দুই দলেই সমান তালে চলছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে যাতায়াত শুরু করে দিয়েছেন। এছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক এবং সংসদীয় দলের বৈঠকে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ বগুড়ার জনসভায় প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকের জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর থেকেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডি এবং বঙ্গবন্ধু এভিনিউ দলীয় কার্যালয়ে প্রতিদিনই নেতাকর্মীদের ভিড় বাড়ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দলীয় বক্তৃতায় সরকারের সাফল্যের বর্ণনা দিয়েও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। নির্ধারিত সময়ের আগেই আওয়ামী লীগ আগাম নির্বাচনে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। কারণ হিসেবে নেতারা বলছেন, মেয়াদপূর্তির পর সংবিধান অনুুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন আবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে। তখন সরকারের হাতে সময় কম থাকবে। তাই নির্বাচনী মিশন সময়ের আগে করতে পারলে আওয়ামী লীগের জন্য মন্দ হবে না।
আবার ক্ষমতাসীনদের অপর একটি মহল ধারণা করছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হলে অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপির কপাল পুড়তে পারে। তাই আগাম নির্বাচন দিয়ে এসব আসনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের ছাড় দেয়ার কৌশল থাকতে পারে আওয়ামী লীগের। সে ক্ষেত্রে দলের বৃহৎ স্বার্থে ছাড় দেয়ার বিষয়টিকে ক্ষমতাসীন এমপিরা সহজভাবেই নেবেন। মূলত ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সরকারের ঝুঁকিমুক্তি পরিকল্পনার অংশ এটি।
আবার আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ কেউ মনে করছেন, বিএনপি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সঙ্কটময় সময় পার করছে। অনেক চেষ্টার পরও দীর্ঘ দিন ধরে দলটি সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। সাংগঠনিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে দলটি। শুধু সংবাদ সম্মেলন আর ঘরোয়া কিছু কর্মসূচি নিয়ে সরব রয়েছে বিএনপি। এসব নানাদিক বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগ চাইছে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার।
পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে শুরু হয়েছে নানা তৎপরতা। সম্প্রতি রাজধানীতে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে উত্তরবঙ্গের এক এমপিকে ধমক দিয়ে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাকে ঢাকা ছেড়ে নিজ এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতর থেকে দেশের সব জেলা ও মহানগীর নেতাদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠান ওবায়দুল কাদের। এতে তিনি নির্বাচনের আগে আর কোনো কমিটি গঠন না করতে নেতাদের বারণ করতে বলেন। একই সাথে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে দলের যে সব নেতাদের বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের ফের দলে সক্রিয় করার কথা বলেন।
এ ছাড়া নির্বাচনী আসনে আওয়ামী লীগের এমপি প্রত্যাশীদের আমলনামা সংগ্রহ এবং দলের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজও ওবায়দুল কাদের তত্ত্বাবধানে চলছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আর গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে বলেই জনগণের ভোটে ক্ষমতা পরিবর্তন চায়। আগাম নির্বাচনের জন্য আমাদের নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হয় না। সব সময় আমরা প্রস্তুত হয়েই থাকি।
অপরদিকে, দল গোছানোর পাশাপাশি আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ভোটের লড়াইয়ে লিপ্ত হতে সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত দলকে তৃণমূল থেকে পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। একই সঙ্গে গোপনে তিনশ’ সংসদীয় আসনে আগামী নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী তালিকা ধরেই কাজ করছেন দায়িত্বশীল নেতারা। এলাকায় জনপ্রিয়তা, দলের জন্য অবদান, দুঃসময়ে মাঠে থাকা ও মামলা মোকদ্দমার সংখ্যাসহ বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের। পাশাপাশি এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে শিগগির মাঠ জরিপের কাজও শুরু হবে। মৃত্যুবরণ, অসুস্থতা, নিষ্ক্রিয়তাসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আগামী নির্বাচনে শতাধিক আসনে নতুন মুখকে মনোনয়ন দেওয়ার আভাস পাওয়া গেছে। এসব আসনে জনপ্রিয়, পরীক্ষিত, ত্যাগী ও যোগ্য তরুণ নেতা ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবছে দলটি। আগামীতে ক্ষমতায় এলে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষে দলের সমর্থক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দকে সদস্য করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না থাকায় দেশে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বিজয়ী দলের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হলে সংকট কমে যাবে। এ ব্যাপারে তারা সরকারকে শিগগির সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা আশা করেন, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা দ্রুত নির্বাচন চান। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো সার্বিক প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। আগামী কিছু দিনের মধ্যে বিচারাধীন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বেশ কিছু সিনিয়র নেতার নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার আশঙ্কা করছেন দলীয় নেতারা। দলের শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্ব শূন্যতার সুযোগে বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে আকস্মিকভাবে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারে সরকার। একই সঙ্গে নেতারা এও বলেন, এ ধরনের আশঙ্কা সত্যি না হলেও সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালে নির্বাচন করলে আর দেড় বছর সময় হাতে আছে। সে ক্ষেত্রেও বিএনপির বর্তমান নাজুক সাংগঠনিক অবস্থা থেকে দলকে নির্বাচনী ভোটযুদ্ধে লড়ার মতো উপযোগী করে গড়ে তুলতে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। এসব হিসাব-নিকাশ করেই বিএনপি সারাদেশে দল গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচনের সম্ভাব্য যোগ্য প্রার্থীদের খোঁজার কাজ শুরু করেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের মতো আর ভুল পথে পা দেবে না বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ওই নির্বাচন বর্জন করলেও ভবিষ্যতে আর ওই অনড় অবস্থানে থাকবে না দলটি। একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে দেশি ও বিদেশিদের মাধ্যমে সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করবে দলটি। তাতে যতটুকু দাবি আদায় করা যায়, শেষ পর্যন্ত তা নিয়েই নির্বাচনে অংশ নেবে দীর্ঘ এক দশক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকেও আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে বলে জানান জন কেরি। সূত্র মতে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার ব্যাপারে বিএনপি দেশে ও বিদেশে জনমত তৈরির জোর তৎপরতা শুরু করবে। খালেদা জিয়া আগামী নভেম্বরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গণসংযোগ করবেন। সভা-সমাবেশে তিনি দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরবেন।