তৃণমূল নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ নির্দেশ : আ’লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা

0
537

নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী জাতীয় নির্বাচন কঠিন হবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তৃণমূল নেতাকর্মিদের প্রতি তিনি পাঁচটি দাবী জানিয়েছেন। দ্বন্দ্ব আর অনৈক্য ঝেড়ে একজোট হয়ে হতে হবে। জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে। যেই নৌকা পাক, খাটতে হবে তার পক্ষে। সরকারের উন্নয়নের কথা তুলে ধরতে হবে এবং জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করে যেতে হবে। এছাড়াও খুলনার নেতাকর্মিদের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মত জাতীয় নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে শনিবার দলের ধারাবাহিক বিশেষ বর্ধিত সভায় এসকল নির্দেশনা প্রদান করেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান। গণভবনে এই সভায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা এবং রংপুর বিভাগের, থানা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত দলের জনপ্রতিনিধিরা যোগ দেন। সভায় খুলনা বিভাগের মধ্যে বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান স্বপন দাসসহ অন্যান্য তিন বিভাগের একজন করে তৃণমূলের নেতা সভায় বক্তৃতা করেন। চেয়ারম্যান স্বপন দাস স্থানীয় সরকারের বরাদ্দ বৃদ্ধি করার দাবী জানিয়ে বলেন, বরাদ্দ বেশি পেলে গ্রামের মানুষের জন্য আরও বেশি করে কাজ করা যাবে। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করেন।
খুলনাকে উদাহরণ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুলনার সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করায় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। একই ভাবে জাতীয় নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ থাকলে সবকটি আসনে বিজয় সম্ভব হবে।
আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে- সেই তথ্য জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই নির্বাচনেও মানুষ যেন নৌকা মার্কায় ভোট দেয়, তার জন্য জনগণের কাছে আপনাদের আবেদন করতে হবে। সে আবেদন আপনারা করবেন, সেটা আমরা চাই।’ আগামী জাতীয় নির্বাচন কঠিন হবে বলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সব দ্বন্দ্ব আর অনৈক্য ঝেড়ে ফেলে একজোট হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে গত ২৩ জুন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের এবং ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে সভা করেন দলীয় সভাপতি। প্রতিটি সভাতেই আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতা-কর্মীদের করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। দেন দলীয় কোন্দল মেটানোর নির্দেশ। বলেন, ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে যেকোনো মূল্যে। সেই সঙ্গে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো তুলে ধরে সেগুলো মানুষের মাঝে বারবার তুলে ধরার তাগাদা দেন তিনি।
বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জন এবং সহিংস আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সহজ জয় পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসবে ধরে নিয়েই কাজ করছে ক্ষমতাসীন দল। গত বৃহস্পতিবার দলের সংসদীয় বোর্ডের সভায় শেখ হাসিনা জানান, এবার নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক। সেই কথারই প্রতিধ্বনি দেখা গেল আজ।
‘দ্বন্দ্ব ভুলে যেতে হবে’
ইউনিয়নের নেতাদের শেখ হাসিনা বলেন, ‘সামনে নির্বাচন অনেক কঠিন হবে, এটা আপনাদের মনে রাখতে হবে।’ ‘সেই সাথে সাথে আমাদের সংগঠনকে গড়ে তুলতে হবে। যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্ব ভুলে যেতে হবে।’ কোনো আসন যেন দ্বন্দ্ব বা অবহেলার কারণে হারাতে না হয়, তার ওপরও জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। ‘দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে একটা ধারণা হয়ে যায়, সবগুলো তো জিতব, এই একটা না জিতলে আর কী হবে? ২০০১ এ কিন্তু এই চিন্তা ছিল। এবার যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়।’ বলে হুশিয়ারী দেন শেখ হাসিনা।

‘জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে’
তিনি আরও বলেন, ‘মনে রাখতে হবে একটা সিট হারানো মানে ক্ষমতা দখল আমরা করতে পারব না। এই কথাটা মনে রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করতে হবে। উন্নয়নের কথাগুলো জনগণকে বলতে হবে এবং দলকে সুসংগঠিত করতে হবে।’ আওয়ামী লীগের সাথে সাথে অন্যান্য সহযোগী সংগঠনকেও শক্তিশালী করার তাগাদা দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। বলেন, ‘মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ-প্রত্যেকটা সংগঠন যেন সুসংগঠিত হয় এবং নিয়ম মেনে চলে, ডিসিপ্লিন মেনে চলে। সেই বিষয়টাতে লক্ষ্য রাখতে হবে। সেই সাথে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে।’
এই নির্বাচনে জিততে না পারলে দেশের ক্ষতি হবে বলেও সতর্ক করে দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। বলেন, ‘এই নির্বাচনে আমরা যদি জয়ী না হই তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা শুরু করেছি, সেই বিচার বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের ওপর আবার আক্রমণ আসবে। আবার বাংলাদেশকে তারা আতঙ্কিত করবে।’ ‘বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে, আবার তারা দারিদ্র্যের হার বাড়াবে। আজকে শিক্ষার হার বেড়েছে, সেটাও তারা কমিয়ে দেবে, সামাজিক নিরাপত্তার কাজ বন্ধ করে দেবে, রাস্তা-ঘাট উন্নয়নের কাজগুলো বন্ধ করে দেবে। অতীতে তাই করেছে।’

‘যেই নৌকা পাক, খাটতে হবে তার পক্ষেই’
যাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে, তার পক্ষেই কাজ করার নির্দেশও দেয়া হয় বর্ধিত সভায়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে সবাইকে প্রস্তুত হতে হবে। যেহেতু আমরা জোট করেছিলাম অবশ্যই জোট বজায় রাখতে হবে। সবাই যেন আমাদের বিরুদ্ধে চলে না যায়, তার জন্য।’
‘কিন্তু সাথে সাথে যাদেরকে আমরা নমিনেশন দেব, অবশ্যই নমিনেশনদেয়ার সময় তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে দেই। কিন্তু তারপরেও আমি সার্ভে করি। ইতিমধ্যে তিন দফা সার্ভে আমার হয়ে গেছে। সেই সার্ভের ওপর ভিত্তিতে যাকে নমিনেশন দেব, যাকেই নৌকা মার্কা দেব, তার পক্ষেই একযোগে কাজ করতে হবে যেন নৌকা না হারে।’

‘উন্নয়নের কথা বারবার বলতে হবে’
বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির নানা পরিসংখ্যান এবং জনকল্যাণে নেয়া প্রকল্প, বিশেষ করে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার মতো সামাজিক কর্মসূচিগুলোর কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। জানান, স্কুল ফিডিং, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ আরও নানা উদ্যোগের বিষয়টি।
এই কর্মসূচির সুবিধা যেন সঠিক লোকেরা পায়, উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি যেন ঠিকঠাকভাবে চলে, সে জন্য নজরদারি করতেও তৃণমূলের নেতাদের নির্দেশ দেন দলীয় সভাপতি। এর পাশাপাশি এসব উন্নয়নের বিষয়টি জনগণকে বারবার জানিয়ে তাদের ভোট চাওয়ার পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শক্তিই হচ্ছে জনগণ। জনগণকে নিয়েই আমরা রাজনীতি করি, জনগণের কল্যাণের জন্যই আমরা রাজনীতি করি। এই কথাটা সাধারণ মানুষের কাছে আপনাদের তুলে ধরতে হবে। বলতে হবে, আমরা আপনাদের কাছে ভোট চাই, আপনাদের কল্যাণে কাজ করতে চাই। আপনাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই।’
‘আমরা যে উন্নয়নগুলো করেছি, মানুষকে বারবার না বললে মানুষ সেটা মনে রাখে না। তাই জনগণের কাছে আপনাদেরকে যেতে হবে এবং এই কথাগুলো বারবার মানুষকে বলতে হবে। যে আমরা এই কাজগুলো করেছি, ভবিষ্যতে আরও করব।’
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই আজ বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয় বর্ধিত সভায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেকটা পরিবার যেন স্বচ্ছল হয়, প্রত্যেকটা গ্রাম যেন উন্নত হয়, আমরা সে পদক্ষেপ নিয়েছি।’
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি আদায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মতো বিষয়গুলো নৌকায় ভোট দেয়াতেই সম্ভব হয়েছিল-এটিও স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন ‘নৌকায় ভোট দিয়েছে বলেই গ্রামের মানুষ সুখের মুখ দেখছে, দুটো পয়সা কামাইয়ের সুযোগ পাচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা পাচ্ছে, হাতে হাতে মোবাইল পাচ্ছে, সুন্দর করে জীবনযাপন করার সুযোগ পাচ্ছে, বাড়ি পাচ্ছে, রাস্তা পাচ্ছে, সবকিছু পাচ্ছে।’
‘আমরা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি। সারাদেশে ইন্টারনেট সার্ভিস চালু করে দিয়েছি। ঘরে বসে ছেলে মেয়েরা অর্থ উপার্জন করতে পারছে। আমরা ট্রেইনিং দিয়ে দিচ্ছি লার্নিং অ্যান্ড আর্নিংয়ের। ডিজিটাল ক্লাসরুম করে দিচ্ছি। এগুলো সাধারণ মানুষের মাঝে তুলে ধরতে হবে।’

‘আ.লীগ করা মানে শুধু নিজের ভাগ্য গড়া না’
জনগণের কল্যাণে কাজ করে যেতেও নেতাদের নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ প্রধান। বলেন, ‘আওয়ামী লীগ করা মানে শুধু নিজের ভাগ্য গড়া না। এটা বিএনপি-জামায়াতের কাজ। দুর্নীতি, লুটপাট, হত্যা করা, এটাই তো তাদের কাজ? নইলে কেউ এতিমের টাকা চুরি করে খেতে পারে?’ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও মামলা থাকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু তিনি হাজিরা দেন না। হাজিরা দিলেই ধরা খাবে। তিনি নাকি অসুস্থ। হ্যাঁ, ক্ষমতায় থাকতে আমেরিকায় গিয়ে, সৌদি আরব গিয়ে চিকিৎসা করেছেন, দেখেছি। কিন্তু হাজিরা দিতে পারবেন না, এতটা অসুস্থ তিনি নন।’

প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি হারুনুর রশিদ বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় প্রধান আমাদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। যাকেই নৌকা প্রতিক দেওয়া হবে তার পক্ষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় দল থেকে বহিস্কার করা হবে বলেও জননেত্রী হুশিয়ার করেছেন। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী তৃণমুল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মিদের মআগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে গড়ে তোলা হবে।

নবনির্বাচিত সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, বিশেষ বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী ৫টি বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই নির্দেশনা মেনে দলকে কাজ করতে হবে। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাব।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান এমপি বলেন, প্রধানমন্ত্রী খুলনার নেতাকর্মিদের ওপর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মেয়র নির্বাচনে আমাদের বিজয় তিনি মাইলফলক হিসেবে দেখছেন। তিনি আরও বলেন, কোন দলীয় নেতার এমপি হওয়ার সুযোগে যদি দল ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা জনগণের কাছে ভাবমূর্তি নষ্ট হয় তবে সেই সব নেতাদের ছাড় দেওয়া হবেনা। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী আমাদের হুশিয়ার করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করে আরও বলেন, আমরা খুলনার সকল নেতাকর্মি ঐক্যবদ্ধ রয়েছি। জাতীয় নির্বাচনে একইভাবে ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করব। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে জনগণের কল্যানে কাজ করে যাব।

সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদ, মহানগর সভাপতি ও নব নির্বাচিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, মহানগর সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মিজানুর রহমান মিজান এমপিসহ এসময় চার বিভাগের জেলা, মহানগর, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।###