টাইমস ডেস্ক:
নিত্যপণ্যের বাজারে সরকার নির্ধারণ করে দেয়া পণ্যের দর ব্যবসায়ীরা তোয়াক্কা করছে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও শুধুমাত্র বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকার বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব সংস্থাগুলো খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নামও অন্তর্ভুক্ত করেছে। অথচ জাতিসংঘ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি বলেছিল বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় দুর্ভিক্ষ হতে পারে। অনাহারে প্রাণ হারাতে পারে প্রায় ৩ কোটি মানুষ। কিন্তু করোনাকালেও এদেশে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু কৃষক খাদ্যশস্য উৎপাদন করেও প্রাপ্য ন্যায্যমূল্যে ওই পণ্য বিক্রি করতে পারছে না। পাশাপাশি ক্রেতারাও ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারছে না। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন হওয়ার পরও চাল-ডাল, আলু-পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম চড়া। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিম্ন-মধ্যবিত্তের ক্রেতারা হিমশিম খাচ্ছে। অথচ বাজার ব্যবস্থাপনার প্রশাসনিক অধিকাংশ পদই শূন্য। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সরকারি জনবলের খুবই জরুরি। কৃষিপণ্য বিপণনের কার্যক্রম উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ ও পদ সৃজন করা দরকার। ওই লক্ষ্যে ২ হাজার ৩২৫টি পদ সৃজনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো অনুমোদন হয়নি। কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং বাজার সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ মূল্য নির্ধারণ করা হলেও বাজার মনিটরিং করার জন্য সরকারের সক্ষমতা নেই। জরুরি হচ্ছে উৎপাদিত পণ্যের সাপ্লাই চেইন ঠিক করা। পরিবহন, জনবল, হিমাগার ও অনলাইনে বাজরের সংকট দূর করতে হবে। শুধু খাদ্য উৎপাদন করলেই হবে না। বরং খাদ্যের সরবরাহ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। নতুবা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিঘিœত হবে।
সূত্র জানায়, খাদ্য বিতরণ, সংগ্রহ, মনিটরিংসহ সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম জনবল সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। দেশে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য রাখার বিশেষায়িত কোনো হিমাগার নেই। ফলে কৃষক ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ ও বিক্রি করতে পারছে না। আর সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু মজুদদার ও ব্যবসায়ীরা কৌশলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। করোনার কারণে শাকসবজি, মৌসুমি ফলসহ কৃষিপণ্যের স্বাভাবিক পরিবহন এবং সঠিক বিপণন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সময়মতো বিক্রি করতে পারছে না, আবার বিক্রি করে ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রান্তিক কৃষকরা যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায়, ভোক্তারা যাতে সহজে, স্বল্প সময়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্য পেতে পারে সে লক্ষ্যে অনলাইনে কৃষিবাজার শক্তিশালী করার দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাত করতে কম শুল্কে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফ্রিজারভ্যান আমদানির দাবি জানানো হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে জনবল সংকটে ভুগছে। বর্তমানে খাদ্য অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে প্রায় ৭ হাজার পদ শূন্য রয়েছে। তার মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বিপুল সংখ্যাক পদ শূন্য আছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ৮৬৯টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ৪৩১টি পদই শূন্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শূন্য পদ আছে ৭ হাজার ২২৬টি। তাতে খাদ্য বিতরণ, সংগ্রহ, মনিটরিংসহ সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। একই সঙ্গে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ভেজালবিরোধী অভিযানও।
এদিকে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার টন হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার টন, গম ৮ লাখ ৪৯ হাজার টন, ভুট্টা ৭ লাখ ৩০ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার টন বা ২৪ শতাংশ বেশি, গম ১২ লাখ ৪৬ হাজার টন বা ৪৭ শতাংশ বেশি, ভুট্টা ৫৪ লাখ দুই হাজার টন উৎপাদন হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন- আলু ৫২ দশমিক ৬৮ লাখ টন থেকে ১০৯ দশমিক ১৮ লাখ টন, ডাল ১ দশমিক ৯৬ থেকে ১০ দশমিক ৪৯ লাখ টন, তেলবীজ ৬ দশমিক ৬১ থেকে ১১ দশমিক ৫৪ লাখ টন, শাকসবজি ২৯ দশমিক ৯ থেকে ১৮৪ দশমিক ৪৮ লাখ টন এবং পেঁয়াজ ৭ দশমিক ৩৬ থেকে ২৫ দশমিক ৫৭ লাখ টন।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দেশের খাদ্য পরিস্থিতিই শুধু উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা। বর্তমানে যেহেতু বিশ্বব্যাপী একটি বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজমান, সে কারণে বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারকে দক্ষতা ও সক্ষমতা দেখাতে হবে। এখন পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদন এবং মজুদে হয়তো সমস্যা নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাজার ব্যবস্থাপনাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রুটিমুক্ত থাকার ওপর পরিস্থিতি মোকাবিলার সাফল্য নির্ভর করবে। মানুষকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু মানুষকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি ও কঠিন কাজ। কারণ স্বাস্থ্যের সঙ্গে এ সরাসরি যুক্ত। সে কারণে সাধারণ মানুষ, উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারীর মধ্যে উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণন নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া কৃষিপণ্যের মূল্য ও মজুদ নিয়ে কারসাজি, অন্যায়ভাবে বাজারকে প্রভাবিত করা, কৃত্রিম সংকট তৈরি করা- এ ধরনের কোনো অব্যবস্থাপনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক ও কঠোর হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, করোনাকালেও দেশে ভালো উৎপাদন হয়েছে। ধান উৎপাদনে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ। তারপরও খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সরকার সব সময় সচেতন। দেশে খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, চাহিদা অনুযায়ী সহজলভ্যতা তৈরি এবং জরুরি অবস্থায় খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে দেশে প্রথম উন্মুক্ত কৃষিবাজার ‘ফুড ফর ন্যাশন’ চালু করা হয়েছে। বাজার মনিটরিংয়ের জন্য জনবলও বৃদ্ধি করা হবে।
একই প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, জনবল সংকট দূর করার জন্য গত ২০ মার্চ নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। করোনাভাইরাসের কারণে ওই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। শিগগির ওই পরীক্ষা নেয়া হবে। তাছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট বিধান মেনে নিয়োগ দিতে হয়। সেজন্য তাড়াহুড়া করা যায় না। চাকরিপ্রার্থীরা যাতে কোনো দালালের খপ্পরে না পড়েন সেজন্য বিশেষ উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে।