সুমন আহমেদ/ফকির শহিদুল ইসলামঃ খুলনা মহানগরীর রায়েরমহল এলাকায় জমির দলিল জাল-জালিয়াতি চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। এতে দিশেহারা সাধারন ভুমি মালিকরা সর্বস্ব খুঁইয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ভুমিদস্যুদের লোলুপ দৃষ্টি পড়লেই জমির মালিকানাতো হাতছাড়া হচ্ছেই, পাশাপাশী দিতে হচ্ছে নিজের জীবনও। প্রায় দু’মাস ধরে চলা খুলনাটাইমস’র অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। মোঃ সফিকুল ইসলাম, শেখ মোঃ সহিদুল্লা (সান্টু), সাইদুল ইসলাম, হায়দার @জামাই হায়দার, শেখ মনিরুল ইসলাম (ফান্টু মনির) ও শেখ সাকিল এর সমন্বয়ে গঠিত এই ভূমিদস্যু চক্র। উৎকোচের বিনিময়ে রেজিস্ট্রি অফিস ম্যানেজ করে রাতারাতি জমির মালিক বনে যান। তেমনি ডুমুরিয়া থানার বিল পাবলা মৌজার জোহরা খাতুনের ৯৮ শতক জমি জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় তারা।
অভিযোগ আছে, চত্রুটির নেতৃত্বে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে স্বরাষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো খুলনার মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকের তালিকাভুক্ত, আওয়ামী লীগ নেতা ও একাধীক হত্যা মামলার আসামি মো: খন্দকার বাহাউদ্দিন। অবশ্য, তিনি খুলনাটাইমসকে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। জমির দলিলমূলে মালিকানা তাদের। আর আদালতে চলমান মামলায় বাদীপক্ষ জয়ী হলে, তিনি তা মেনে নেবেন। আর জমি জাল-জালিয়াতি চত্রুটির নেতৃত্বে দেয়া প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে এমন নানা অভিযোগ আনছে। তবে এর কোন সত্যতা নেই।
জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর রায়েরমহল এলাকার মৃত গফুর শেখ। ছিলেন ৯ একর সম্পত্তির একক মালিক। তবে ছিল না কোন পুত্র সন্তান। এজন্য ১৯৫০ সালে তার সকল সম্পত্তি তিন কন্যা জোহরা খাতুন, মোমেনা খাতুন, আম্বিয়া নেছারকে যাবতীয় সহায় সম্পত্তি হেবা দলিল করে যান। গফুর শেখের মৃতুর পর তার বাড়িতে অবস্থান নেন তারই কন্যা আম্বিয়া নেছা। জোহরা খাতুন, মোমেনা খাতুন, আম্বিয়া নেছার নামে দেয়া গফুর শেখের হেবা দলিল মূলে ১৯৬২ সনের এস/এ রেকর্ড ভূক্ত হয়। কিন্ত সম্পত্তির পাশে থাকার সুবাধে আম্বিয়া নেছা ও তার স্বামী ইদ্রিস মহুরী বাংলাদেশ জরিপ আর/এস রেকর্ডে জোহরা খাতুন, মোমেনা খাতুনকে মৃত দেখিয়ে সমুদয় সম্পত্তি এককভাবে তাদের একমাত্র কন্যা মাহামুদা সুলতানা @হুরির নামে রেকর্ড ভুক্ত করেন।
২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর আম্বিয়া নেছা হৃদযন্ত্রে আক্রান্ত হয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন । ৬ দিন চিকিৎসা শেষে ২৮ ডিসেম্বর আম্বিয়া হাসপাতাল থেকে ত্যাগ কওে এবং তার চাচাতো মামার ছেলে শেখ মোঃ সহিদুল্লা (সান্টু)’র বাড়ি এসে ওঠেন। তখন থেকে তিনি পক্ষঘাত গ্রস্থ (প্যারালাইস্ড)। পঙ্গু ও বোধ শক্তিহীন হয়ে সে মানসিক রুগিতে পরিনত হয়। আত্মীয় স্বজন বোনদের তিনি চিনতে বা নামও বলতে পারেন না। ২০১৭ সালের ২৪ জানুযারি আম্বিয়া নেছা মৃত্যু বরন করেন। অবশ্য, মৃর্ত্যুর পূর্বে আম্বিয়া নেছার কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি তার ও অন্য দুই বোনের সম্পত্তি নিজ কন্যা মাহামুদা সুলতানা @হুরির নামে রেকর্ড ভুক্ত করে যান।
২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মোঃ সহিদুল্লা (সান্টু), মোঃ সফিকুর রহমান রায়েরমহল মৌজার ২০ শতক ও হাসান খালী মৌজায় শূণ্য দশমিক ২৫ শতক জমি মৃত আম্বিয়া নেছার কন্যা মাহামুদা সুলতানা @হুরি নিকট থেকে ডুমুরিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে পন মুল্যহীন একটি পাওয়ার (দলিল নং-১০০৩) করিয়ে নেয়। এরপর একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মোঃ সহিদুল্লা (সান্টু) হরিনটানা থানাধীন রায়েরমহল মৌজায় ৪৫ শতক জমি একই প্রক্রিয়ায় পাওয়ার অব এ্যার্টনী করেন (দলিল নং-১২৫৬) ডুমুরিয়া সাব রেজিট্রি অফিস হতে। আর এই ৪৫ শতক জমি শেখ মোঃ সহিদুল্লা সান্টু নিজের পুত্র সন্তান শেখ মোঃ সাকিল এর কাছে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা নগদে লেনদেন করিয়া আরেকটি বায়না দলিল সৃষ্টি করে।
শুধু তাই নয় সহিদুল্লা সান্টু, সফিকুর রহমান ও মনিরুল ইসলাম ফান্টু ২০১৭ সালের ১০ এপ্্িরল একই প্রক্রিয়ায় ১ একর ১ শতক জমি খুলনা রেজিস্ট্রি অফিসে ১৭৮৪নং দলিলে পাওয়ার করিয়ে নেয়। এ ঘটনা জানতে পেরে আম্বিয়া নেছার বোনের পুত্র আহমাদুজ্জামান খাঁন, একই সময় সে তার খালাতো বোন অসুস্থ মাহামুদা সুলতানা@হুরির কোন খোঁজ পায় না। অবশেষে হুরির সন্ধান চেয়ে হরিনটানা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। এরই ধারাবাহিকতায় হরিনটানা থানার এসআই সঞ্জয় কুমার দাস আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন শেখ সহিদুল্লা সান্টু অসৎ উদ্দেশ্যে মাহামুদা সুলতানা হুরিকে গোপন করে রেখেছে।
এতে ম্যাজিট্রেট আদালত থেকে একটি তল্লাসী পরোয়ানা ইস্যু করা হয়। সে খবর পেয়ে শেখ শহিদুল্লা সান্টু হুরিকে পুলিশের কাছে হাজির করে। এরপর এস আই সঞ্জয় কুমার দাস মাহামুদা সুলতানা@হুরিকে পাওয়া গেছে বলে আদালতে তল্লাসী পরোয়ানা স্থগিতের আবেদন করেন। অবশ্য এই স্থগিতের আবেদনের প্রেক্ষিতে ম্যাজিট্রেট আদালত মামলাটি নথিভূক্ত করেন, সেখানে শহিদুল্লা সান্টুকে প্রধান আসামি করা হয়।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট মাহামুদা সুলতানা@হুরি মৃত্যু বরন করেন। এসময় রায়েরমহল এলাকায় জোরেশোরে গুঞ্জন ওঠে সম্পত্তি আত্মসাৎ করতেই হুরিকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হুরির মৃর্ত্যুর ৪দিন পর ২০ আগষ্ট খুলনা রেজিষ্ট্রি অফিসে ৪৩৩৩ ও ৪৩৩৪নং দলিলে এবং একই বছরের ১০ অক্টোবর ৫২০৯নং দলিল মাহামুদা সুলতানা @হুরি করে দেন বলে দেখানো হয়। এসব দলিলে সনাক্তকারী ও স্বাক্ষী ৭জন ব্যাক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দলিলে নেই কোন স্থানীয় মুরুব্বী বা হুরির কোন আত্মীয়স্বজন। এখানে হুরির স্থলে শফিকুরের বোন ও হায়দারের স্ত্রী এই সকল দলিল করে দেন বলে এলাকায় গুঞ্জন আছে।
অভিযোগ আছে, শফিকুর রহমান, শহিদুল্লা সান্টু, হায়দার, মনিরুল ইসলাম@ফান্টু মনির ও শাকিল মিলে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। কারণ ছিলো হুরির সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া। এনিয়ে হুরির খালাতো ভাই ও জোহরা খাতুনের বড় ছেলে বয়রা নিবাসী আশরাফুজ্জামান খাঁন দুদক খুলনায় চলতি বছরের ১৩ আগস্ট অভিযোগ দেন। যার অনুলিপি কর অঞ্চল খুলনা ও জেলা প্রশাসক বরাবর দাখিল করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাল-জালিয়াতির অভিযোগ এনে রেকর্ড সংশোধনীর জন্য জোহরা খাতুনের ওয়ারিশরা বাদি হয়ে ডুমুরিয়া সহকারি জজ আদালত খুলনায় মামলা করেন। মামলায় বিবাদীরা হচ্ছে আড়ংঘাটা থানা এলাকার সহিদুল্লা সান্টু, সফিকুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম ও শেখ মো: সাকিল।
বলা বাহুল্য, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে জোহরা খাতুনের সেজো পুত্র আনোয়ারুজ্জামান খান বাদি হয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত খুলনায় উপরেল্লেখিত বিবাদীদের বিরুদ্ধে জোহরা খাতুনের মালিকানার পুরো ৯৮ শতক জমির ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করতে মামলা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করে আড়ংঘাটা থানা পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। তবুও ব্যাপক প্রতাপশালী এই ভূমিদস্যু চক্রটি সেখানে আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে তানিশা আবাসিক প্রকল্প’র প্রজেক্ট নং-৮ নামের একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে। সাইনবোর্ডে নাম আছে মহানগর আওয়ামী লীগের ১৬নং ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক মো: খন্দকার বাহাউদ্দিন’র। সে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে প্রকাশিত মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকের তালিকাভূক্ত। এনিয়ে মামলার বাদিপক্ষ আপত্তি জানালে তাদেরকে প্রাণনামের হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আরও জানা গেছে, জাকির মহুরী হত্যা মামলার প্রধান আসামী এই খন্দকার বাহাউদ্দিন। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা শাহাদৎ হোসেন হত্যা মামলায় প্রধান সন্দেহভাজন বলে আলোচিত। খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের ১৬নং ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে জবরদখলে লিপ্ত রয়েছে। তার নেতৃত্বে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভুমিদস্যু চক্র। চত্রটির মধ্যে রয়েছে মোঃ সফিকুর রহমান, শেখ মোঃ সহিদুল্লা (সান্টু), সাইদুল ইসলাম, শেখ মনিরুল ইসলাম (ফান্টু মনির), শেখ সাকিল। এদের সহযোগী হিসেবে রয়েছে হায়দার @জামাই হায়দার, সাইদুল মুন্সী, ইউনুস মুন্সি @ ইউনুস মাষ্টার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রায়েরমহল প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বাশতলা খালটির দূষণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। এর চেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে প্রায় ৭২ ফুট প্রসস্থ খালটির রায়েরমহল অংশে পরিলক্ষিত হলেও বাইপাস সড়কের অপর প্রান্তে তার চিহৃ মেলে না। শুধুমাত্র একটি নালা পরিলক্ষিত হয়। যেখানে পানির প্রবাহ নেই। এই খালটি এখন ভূমিদুস্যদের আগ্রাসনে নালায় রূপ নিয়েছে। বালি ফেলে পানির প্রবাহ রুদ্ধ করা হয়েছে। চক হাসান খালি মৌজায় বাশতলা খালটি এখন ১২/১৪ফুট। এর বাকি অংশ চলে গেছে ভূমিদস্যুদের তৈরি আবাসন প্রকল্পগুলোর মধ্যে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য তানিশা আবাসিক প্রকল্প। এ প্রকল্পটির বাস্তবায়নে খালের ওপর দিয়ে কংক্রিট ঢালাই দিয়ে দুটি ক্ষুদ্র সেতু করা হয়েছে। আরও দেখা গেছে, হুরির মায়ের দিঘি বলে পরিচিত স্থানটির বালি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। ১ একর ১শতকের দিঘিটি একদা স্থানীয়দের নিত্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মেটাতো। তবে এখন ভরাট হওয়ার সে চাহিদার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
সূত্র দাবি করছে, বাশতলা খাল সংলগ্ন তানিশা আবাসিক প্রকল্পটির সম্পূর্ণ সরকারি খাস জমির ওপর করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মূল জমি হচ্ছে ৬৫ শতক। আর এর মালিক মুকিতুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। তিনি রায়েরমহল এলাকার আলহাজ্ব শেখ আবু দাউদের নিকট ১৬শতক জমি ক্রয় এবং ২৯ শতক জমি বায়না রেজিস্ট্রি করে। এরমধ্যে ১৬ শতক জমি তানিশা আবাসিক প্রকল্পের পরিচালক সফিকুরের কাছে বিক্রয় করেন আবু দাউদ। ক্রয় করা এই ১৬ শতক জমির ওপর ভর করেই গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল তানিশা প্রকল্পটি। এরমধ্যে রয়েছে সরকারের বেশিরভাগ খাস জমি, খাল ভরাট করা জমি।
এই সেতু নির্মাণ করার ক্ষেত্রে কোন অনুমতি নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, তানিশা আবাসিক প্রকল্পের পরিচালক সফিকুল ইসলাম খুলনাটাইমস’র কাছে বলেন, খালের ওপর সেতু নির্মাণ করতে জেলা প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন হয়। তবে আমরা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনুমতি নিয়ে এই সেতু করেছি। তাছাড়া জমি ক্রয়কারীদের সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজন অনুধাবন করলে খালের জমি নিয়ে নিতে পারে, আবার নির্মিত সেতুও ভেঙে দিতে পারে। এমন কথায় আশ্বস্ত হয়েই জমি বিক্রি করা হয়েছে।