শেখ নাদীর শাহ্,নিজস্ব প্রতিবেদক:
মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রনাঙ্গন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন হলেও দীর্ঘ দিনেও তার কার্যক্রম শুরু হয়নি। মূলত নির্ধারিত স্থানে কাটা তারের ঘেরা-বেড়ায় আটকা পড়ে গেছে এর সামগ্রিক কার্যক্রম। কপোতাক্ষের চরভরাটি খাসজমিতে গত ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবসে সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষযক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করেন। এর কয়েক দিন পর জায়গাটি নিজেদের মালিকানাধীন দাবি করে সেখানে কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নেয় স্থানীয় অমিত সাধু গং।
বহুলালোচিত জায়গাটি বে-দখলের খবরে গত ১৩ জানুয়ারী সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে তৎকালীণ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো: আরাফাতুল আলমের নেতৃত্বে কাটাতারের বেড়া অপসারণপূর্বক ঐ সম্পত্তির অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়।
এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর ২০’ ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবসে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন, স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু উপস্থিত থেকে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন। তারও আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো: আরাফাতুল আলম, স্থানীয় ইউএলএও হাসমত, উপজেলা সার্ভেয়ার মো: কাওছার আলীসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থেকে কমপ্লেক্সের স্থান নির্ধারণ ও জরিপকার্য সম্পন্ন করেন।
তবে সাবেক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো: আরাফাতুল আলমের বদলিকালীণ সময়ে আধুনিক কপিলমুনির রুপকার রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ভ্রাতা কুঞ্জ বিহারী সাধুর ওয়ারেশরা ফের ঐ সম্পত্তি তাদের বলে দাবি করে পুনরায় কাটাতারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, ২০১৩ সালে কপোতাক্ষের চরভরাটি খাস খতিয়ানের ৫৯৫ দাগের বিস্তীর্ণ সম্পত্তির মধ্য থেকে স্থানীয় জনৈকা মালঞ্চ নামের এক গৃহ ও ভূমিহীন মহিলাকে খুলনা জেলা প্রশাসক ১০ শতক জমি বন্দোবস্ত দেয়। তবে বরাবরই ঐ সম্পত্তির দখল নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয় মালঞ্চ বিবি। এ নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা-পাল্টা মামলারও ঘটনা ঘটে। বিষয়টি অবহিতপূর্বক তখন মালঞ্চ জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐবছরের ৩০ জানুয়ারি তিনি ২০১৮, ০৫.৪৪.৪৭০০.০৩১.৩৩.০০১.১৮-১৪৫৫ নং স্মারকে দখল ও সীমানা বুঝে দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাইকগাছাকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মালঞ্চ বন্দোবস্তকৃত সম্পত্তির দখল নিতে গেলেও বাঁধার মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হন। এরপর মালঞ্চ সর্বশেষ গত বছরের ৫ মে পুনর্দখল বুঝে পেতে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি আবেদন করলে ইউএনও ৬ মে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে কপিলমুনি ভূমি অফিসের ইউএলও এবং স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাবুল হোসেনকে নির্দেশ দেন। যার প্রাপ্তি নং-২৯৪। সর্বশেষ ইউএনও’র অনুমতিতে স্থানীয় ইউএলও-স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় ১৪ মে সকালে কপোতাক্ষ তীরের বন্দোবস্তপ্রাপ্ত খাসজমিতে তৃতীয় দফায় ঘর বাঁধতে গিয়েও দখলদারদের বাধার সম্মুখীন হন।
ঐ ঘটনায় ১৬ মে পাইকগাছা বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্থানীয় দখলদারদের একজন তপন কুমার সাধুর ছেলে অমিত সাধু ওরফে শান্ত বাদী হয়ে স্থানীয় ইউএলএও মো: জাকির হোসেন ও স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ কয়েকজনকে আসামী করে একটি মামলাও করেন। যা পিবিআিই’র তদন্তে মিথ্যা প্রমানিত হয়।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য (পাইকগাছা-কয়রা) খুলনা-৬ মো: আক্তারুজ্জামান বাবুর মধ্যস্থতায় মালঞ্চকে অন্যত্র পূণর্বাসন করলে ফের ঐ সম্পত্তির দখলে যান অমিত ওরফে শান্ত সাধু গং। এরপর কপিলমুনি মুক্ত দিবসকে সামনে রেখে সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রনাঙ্গন কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নিলে নড়ে চড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রশাসনের দফায় দফায় বৈঠকে ঐএলাকা নির্ধারিত স্থান বলে চিহ্নিত ও কয়েক দফায় সার্ভেয়াররা জরিপ করে সীমানায় লাল পতাকা টানিয়ে দেন। এরপর ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। তবে এরপরও বন্ধ হয়নি এর দখল কার্যক্রম। সম্প্রতি তারা ফের ভিত্তিপ্রস্তরসহ গোটা এলাকায় কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ’৮০-এর দশক থেকে প্রথমে কপোতাক্ষের ব্যাপক ভাঙন ও পরবর্তী পর্যায়ে নাব্যতা হ্রাসে কপিলমুনি সদরের কপোতাক্ষের তীর জুড়ে গড়ে ওঠে বিস্তীর্ণ চরভরাটি খাসজমি, যা সরকারের সর্বশেষ মানচিত্রে ১ নম্বর খাস খতিয়ানের ৫৯৫ দাগে চিহ্নিত হয়। এরপর নদের নাব্যতা হ্রাসে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ হয়ে বর্ষা মৌসুমে স্থায়ী জলাবদ্ধতা ও জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এক পর্যায়ে আন্দোলনের মুখে সরকার কপোতাক্ষ নদ খননের কাজ শুরু করে। ওই সময় খননের উচ্ছিষ্ট মাটি দুই পাড়ে ফেলায় কপিলমুনি অংশে দৃশ্যমান হয় বিস্তীর্ণ খাস জমির। আর সেই সুযোগে শুরু হয় এর দখলপ্রক্রিয়াও। ক্রমাগত চরভরাটি জমির সীমানা লাগোয়ারা দখল নিতে থাকেন জেগে ওঠা জমির।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিলো দক্ষিণ খুলনার অন্যতম প্রধান রাজাকার ঘাঁটির রাজাকাররা। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করেন ১৫৫ জন রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীকে। রাজাকার ঘাঁটি থেকে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন কাগজপত্রের সাথে পাওয়া যায় রাজাকারদের হাতে লেখা এক হাজার ৬০১ জন শহীদের তালিকা। রাজাকারদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে এলাকার আরো ১ হাজার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের তালিকা পাওয়া যায়। ক্যাম্প থেকে এদিন দেয়ালে পেরেকবিদ্ধ সৈয়দ আলী গাজী নামে এক মুক্তিযোদ্ধার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আতœসমর্পণের খবরে সহচরী বিদ্যা মন্দিরের মাঠে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের গণআদালতে এদিন ১৫১ জন রাজাকারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীণ গণআদালতের রায়ে এক সঙ্গে এত সংখ্যক রাজাকারের শাস্তির সম্ভবত এটাই একমাত্র ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপুঞ্জ অবগত হওয়ার পর সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বর ২০’ কপিলমুনি মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানে সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক উপস্থিত থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ঐ অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন সচিব ইউসুফ হারুন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন, সহকারী কমিশনার(ভূমি) মো: আরাফাতুল আলমসহ সরকারি,বে-সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের নের্তৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
তবে এরপরও ভিত্তিপ্রস্তরসহ গোটা এলাকায় কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলের ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধের কমপ্লেক্স নির্মাণে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। যদিও প্রশাসনের পক্ষে বলা হচ্ছে, যথা সময়ে সম্পূর্ণ সরকারি জমিতেই নির্মিত হবে কপিলমুনি মক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স।
এব্যাপারে স্থানীয় কপিলমুনি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমবায় সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার ফারুখ আহম্মেদ বলেন, স্থানীয় কতিপয় মহলের ইন্ধনে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকৃত নির্ধারিত স্থানে কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দেয়া হয়েছে। এনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এমপি,ইউএনওসহ সকলের সাথে কথা হয়েছে। সময় হলে বেড়া উচ্ছেদ করা হবে।
কপিলমুনি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউএলএও মো: সবুর হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স ভবনের ভিত্তিপ্রস্তরের নির্ধারিত স্থানেই সেটি হবে। আর কাটাতারের বেড়াটি নাকি তারাই অর্থাৎ সরকারিভাবে সংরক্ষনের জন্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কমপ্লেক্স ভবন বাস্তবায়নে সরকারি জায়গায় সংকুলান হবেনা। সেক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানাধীন কিছু জমি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে পেছনের মালিকপক্ষ দাবি করেছে তাদের বেরোনোর পথ দিলে তারা মালিকানাধীন প্রয়োজনীয় সম্পত্তি ছেড়ে দেবেন। এব্যাপারে সোমবার কানুনগো, সার্ভেয়ারসহ তিনি কয়েক দফায় পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া খুব শিঘ্রই কমপ্লেক্স ভবনের কাজ শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
বাজার বণিক সমিতির সদস্য সচিব ও প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক জি,এম আব্দুর রাজ্জাক রাজু বলেন, সরকার কপিলমুনির ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপুঞ্জ জানতে পেরে বৃহত্তর স্বার্থে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনা পেলে আমরা এলাকাবাসীর পক্ষে প্রশাসনকে সাথে নিয়ে বেড়া উচ্ছেদ করব।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো: কওছার আলী জোয়াদ্দারকে মঙ্গলবার ২ টা ১০ মিনিটে ফোন দিলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এব্যাপারে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স শত ভাগ খাস জায়গায় নির্মিত হচ্ছে। সুতরাং ব্যক্তি বিশেষ এই জায়গা দখলের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।