হিমালয় কন্যা নেপালের পথে পথে-২

0
613

শেখ ফারুক হাসান হিটলু:
দুইটা ফোর হুইল ড্রাইভ জীপ গাড়ী। পাথর বোল্ডারে ভরা সরু বিপদসংকুল সুউচ্চ পাহাড়ের গাবেয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছে। দুর্গম পাহাড়ের গায়ে থাকা বন্য প্রাণীদের চলার পথ, ক্রমান্বয়ে মানুষের যাতায়াতের কারণে রাস্তায় রূপ নিয়েছে। পাথর আর পাহাড় কেটে সেখানে আধুনিক কালের পাকা রাস্তা বানানোর প্রাথমিক কাজ চলছে। নেপাল সরকার সুদূর চীনের বর্ডার পর্যন্ত কানেক্টিভিটি বাড়ানো ও ব্যবসার প্রসারের জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপরও হিমালয়ের আদিম রূপটি এখনো বিদ্যমান। একপাশে পাহাড় আর একপাশে অনেক নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদী। নদীর অপর পাড়ে কিছুটা সমতল বাদ দিয়ে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে আকাশের দিকে। যন্ত্র দানব বড় বড় পাথর , গাছপালা কেটে পথটাকে সোজা ও প্রস্থে বড় করছে । পথে পথে বাঁক। শক্ত পোক্ত দক্ষ ড্রাইভার পাথরের মতো নীরব চোখে পথ দেখে গাড়ী চালাচ্ছে। ভুল করার কোন সুযোগ নেই। ভুল হলেই জীবনহানির আশংকা । প্রতিমুহূর্তের সতর্কতা স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টি করছে। ধীর স্থির মন্থর বেগে চলছি। আর কখন যে পথে নেমেছি বুঝি ভুলেই গেছি। গত রাতে দেরিতে ঘুমাতে যাওয়ায় সকালবেলা রওনা করতে দেরি হয়েছে। প্রাতরাশ সেরে সবকিছু গুছিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে পোখরার পাহাড়, লেক, মানুষ ও প্রকৃতির জন্য অজানা শুন্যতা এসে ভর করে। যদিও অল্প সময়ের জন্য এখানে আসা, তবুও ভাবনায় দাগ কাটে এই শৈল শহর। অনেক দূরের পথ তাই শর্ট কাটে শহর এড়িয়ে, পাহাড়ি পথ ধরে ড্রাইভার। এই পথের গাইডও সে। বসতি কমে আসলেও মানুষের চলাচল আছে এই পথে। বেশ দূরে দূরে এক একটা বসতি । জনহীন পাহাড়ে চলতে চলতে হঠাৎ পাওয়া বসতিগুলো প্রাণের স্পন্দন নিয়ে আসে। কোথাও দলবেঁধে ছেলে মেয়েরা স্কুলের পোশাকে পথ চলছে। পথ চলতি মহিষ, ড্রাইভারকে গাড়ীর গতি মন্থর করতে বাধ্য করছে। ইউরোপিয়ান এক পরিব্রাজকের দেখা পাই। মাথার চুলে জটা, ব্যাগ কাঁধে হেঁটে চলেছে। কোন গন্তব্যে যাওয়ার তাড়া আছে বলে মনে হয়না। তাকে দেখি আর ভাবতে থাকি, মনের আনন্দে হেঁটে হেঁটে অজানাকে জানার নেশাই যেন সঙ্গী। পথের ধুলো তার বন্ধু। মানুষের সাথে ভাব বিনিময়ই পরম আকাংখা। প্রকৃতির মাঝে চলতে চলতে যদি মৃত্যুও হয় তাই সই , এমনই ভাবলেশহীন তার চোখ। রাস্তার কাজের জন্য পাহাড় ধ্বসে পথ বন্ধ। এক ঘণ্টা বসে রইলাম। এক্সকাভেটর এনে সরকারি লোকেরাই মাটি পাথর সরিয়ে চলার পথ স্বাভাবিক করল। গাড়ী চলতে শুরু করল। পাহাড় থেকে নামতে নামতে নদীর উপর ছোট লোহার ব্রিজ পার হয়ে এলাম আবার পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। চারিদিকে বিশাল বিশাল পাহাড় চূড়া যেন আকাশ ছুয়ে ফেলবে। পাহাড়ি নদী আমাদের সাথে সাথে চলছে। অনেকক্ষণ চলার পরে ছোট্ট একটা বসতি পেলাম নদীর সমতলে । সেখানে থেমে হাত পায়ের জড়তা কাটালাম। চা পান করলাম । আবার চলতে শুরু করলাম। বেলা বাড়তে বাড়তে দুপুর গড়িয়ে গেল। চারদিক কেমন নিস্তব্দ। পথের পাশ দিয়ে নদী সরে গেল। দুই পাশের পাহাড় তার মাথার উপরের বৃক্ষরাজি নিয়ে, এ গহীন পথের যাত্রীদের উপুড় হয়ে দেখে নিচ্ছে । বন্য পাখির কল কাকলি শোনা যাচ্ছে। গাড়ীর ইঞ্জিনের একটানা শব্দ , সবাই চুপচাপ নিজের মধ্যে ডুব দিয়েছে। আবার নদীর সমান্তরালে চলে এসেছে রাস্তা। হঠাৎ দেখি গাড়ীর চারপাশ মেঘের মতো কিছুতে ঢেকে যাচ্ছে। গাড়ীর চাকা গুলো অর্ধেক দেবে গেছে। এক মুহূর্তে পুরো শরীর ধূসর। চুলে, মুখে, চোখে প্রবেশ করছে মিহি পাউডার। গাড়ীর জানালার কাঁচ দ্রুত বন্ধ করলাম। ভাবলাম বুঝি কোন পাউডার কোম্পানির সীমানায় অনুপ্রবেশ করে ফেলেছি। গাড়ী দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখি রাস্তা তৈরীর জন্য, পাহাড়ের পাথর গুলো কাটতে গিয়ে যন্ত্রের ঘর্ষণে হাঁটু সমান পাউডার জমেছে। আর বিশাল এক পাথর পাহাড়ের উপর থেকে পড়ে পথ আটকে ফেলেছে, সাথে মাটির চাই ও পাহাড়ি গাছপালা। আবারও অপেক্ষা কখন রাস্তা চলাচলের উপযোগী হয়। বিকাল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি গাড়ী চলতে শুরু করল। পথেই একটা চেকপোস্ট।
চেকপোস্টের ওপারে আরও দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। পাসপোর্ট জমা দিয়ে নামধাম এন্ট্রি করিয়ে, দেশে পিতামাতার জরুরি ফোন নম্বর লিখে দিয়ে, একটা লিখিত অনুমতিপত্র পেলাম, সামনের পথ চলার। এত কিছু লিখতে গিয়ে অজানা শঙ্কা ভর করে মনে। এই গহীন বিপদ সংকুল হিমালয় পর্বতের কোথাও যদি পথ হারাই। আর না ফিরি। চলতে চলতে দেখি সূর্যের আলো কমে আসছে। দ্রুত সন্ধ্যা নামল হিমালয়ের এ অংশে। গাড়ীর হেড লাইটের আলো পাথুরে রাস্তার ঝাঁকুনিতে ওঠানামা করছে। তাতে যতটুকু পথ দেখা যায়, তার বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। শীতও জাঁকিয়ে বসেছে। মোটা জ্যাকেট, হাতমোজা, মাঙ্কি টুপি , গলায় মাফলার দিয়েও ঠা-া দূর করা যাচ্ছে না। হাত ব্যাগ থেকে চাদর শরীরে জড়িয়ে , গাড়ীর হিটার চালিয়ে ভিতরটা উষ্ণ করা গেল। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে ভাবছি কতটা ধীর স্থির ও অভ্যস্ত হলে এমন ভংয়কর পথে, রাতের অন্ধকারে গাড়ী ড্রাইভ করা যায়। চলতে চলতে দেখি সরু পথের এক জায়গায় একটি লক্কড় ঝক্কড় বাস নষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর বাসের নেপালি যাত্রীরা ধাক্কা দিচ্ছে। যদি বন্ধ ইঞ্জিন আবার চালু হয়। ব্যর্থ হয়ে সকলে মিলে ধাক্কা দিয়ে আমাদের গাড়ীর জন্য একটুখানি পথ করে দিল। বাসের যাত্রীরা সকলেই শ্রমিক। সারাদিন কাজ শেষ করে । যার যার আবাসে ফিরছে। পথে এই ঝামেলা। ভাবছি কখন বিকল্প যানবাহন পাবে আর বাড়ী ফিরবে। স্ত্রী, সন্তানরা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে। আবার সকালে দূর দূরান্তে কাজের জন্য বের হবে। জীবন সত্যিই কঠিন এই পাহাড়ে। ঝাঁকুনি আর টক্কর খেতে খেতে গাড়ী চলছে অন্ধকারে। পথের বুঝি আর শেষ নাই। অনেকক্ষণ পরে উপত্যাকার মতো সমতল একটা জায়গায় বসতি দেখে গাড়ী থামিয়ে ড্রাইভার বলল, এখানেই রাতের আহার সারতে হবে। সামনে আর কোথাও খাবার ব্যবস্থা নাই। ছোট্ট একটা পরিবার এখানে থাকে। পর্যটকদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে। যদিও এই ভয়ংকর পথে পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। সারাদিন ভাল করে খাওয়া হয়নি সকলের। এই ভিষন ঠা-ায় গরম পানি দিলেন তারা। হাতমুখ ধুয়ে আরাম পেলাম। ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডিম ভাজি, সবজি, ডাল দিয়ে আহার সারলাম। আমাদের দেশের মতই রান্না। শেষে এক পেয়ালা চা পেয়ে কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম। গাইড কাম ড্রাইভারের তাড়ায় আবার রওনা করলাম অজানা…
( লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, খুলনা মহানগর ছাত্রলীগ।)