সুবোধের বোধ ও বাংলাদেশের প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি

0
722

অনলাইন ডেস্কঃ ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ সংলগ্ন এলাকায় চোখে পড়েছিল এই ছবিটি। পলায়নরত সুবোধকে এভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল পোস্টার দিয়ে। সুবোধের এই গ্রাফিতিতে লেখা ছিল, ‘এখানে সাপ ভরা চাপ চাপ রুচি! কাপ ভরা পাপ পাপ চা! সুবোধ… তুই পালিয়ে যাহ!

তো এই ‘চাপ চাপ রুচি’র দারুণ প্রয়োগই ঘটিয়েছিলেন পোস্টার লাগানেওয়ালারা। এই একটা গ্রাফিতি ঢেকে দেওয়ার প্রয়াসে তারা সফল হয়েছিলেন খুব সফলভাবে! কিন্তু ঢাকা শহরে তো সুবোধ ছড়িয়ে গিয়েছিল ততদিনে। মানুষের মনে ততদিন প্রশ্ন উঠে গেছে যে, কে এই সুবোধ? কেন পালাতে বলা হচ্ছে তাকে? ‘এখন সময় পক্ষে না’ যে বলা হচ্ছে, তো এটা কোন সময়? কেমন সময়? যে সময়ে সূর্যকে খাঁচাবন্দী করে পালিয়ে যেতে হচ্ছে সুবোধকে? এসব প্রশ্ন আর খোদ এই সুবোধের খোঁজ করতে গিয়ে কিছু বন্ধু মিলে বানানো হয়েছিল এই ভিডিওটি।

ঢাকার রাস্তায় কে বা কারা এই সুবোধকে চিত্রিত করেছেন তা জানা যায়নি আজ অব্দি। চেষ্টা হয়তো হয়েছেও কিছু, সুবোধের ঠিকুজি-কুলজি জানার। কিন্তু সেই সন্ধান পাওয়া গেছে- এমন খবর পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। নামধারী এই অচেনা চিত্রকর পচে-গলে যাওয়া, দমবন্ধকরা এক মৃত্যুপুরির শহরে যেন হঠাৎ করেই কিছু ফুল ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেয়ালে দেয়ালে পলায়নরত সুবোধকে চিত্রিত করে। মানুষ মুগ্ধ হয়েছিল এর অঙ্কনশৈলি দেখে। কী এটা? সুবোধ আবার কী?- শুরুতে এমন প্রশ্ন। এরপর একটু একটু করে প্রশ্ন গাঢ় হতে শুরু করল। সুবোধ কী তবে সু-বোধ? মানুষেরই, আমার-আপনারই বোধশক্তি? নাড়া পড়ল চেতনায়।

মনোচৈতন্যে নাড়া দেওয়ার এই কাজটা সুবোধ সিরিজের গ্রাফিতিগুলো খুব ভালোভাবেই করতে পেরেছে বলে প্রতিয়মান হয়। সুবোধ খুব অল্প সময়ের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুবোধকে নিয়ে বাঁধা হয়েছে গান-কবিতা। বানানো হয়েছে টি-শার্ট। সুবোধের বোধ কাঁটাতারের গণ্ডিও পেরিয়ে গেছে অনায়াসেই। কোনো পাসপোর্ট-ভিসার ধার ধারতে হয়নি সুবোধকে।

কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেখানকার শিক্ষার্থীরা সুবোধকে দেখেছেন লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে। তারা সুবোধকে দিয়েছেন ইতিবাচকতা। সুবোধকে বলেছেন তৈরি হতে, ঘুরে দাঁড়াতে, ছড়িয়ে যেতে। হয়েছেও তো খানিকটা সেরকমই। ২০১৮ জুলাই-আগস্টে কিশোর বিদ্রোহের তোলপাড় করা সেই দিনগুলোতে একটি ছবি অনেকেরই নজর কেড়েছিল। বাংলাদেশের কিশোররা যে অসাধারণ কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছিল তাদের প্ল্যাকার্ডগুলোতে- সেখানে ঠাঁই হয়েছিল এই সুবোধেরও। একজনের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা হয়েছিল, ‘সুবোধ এখন রাস্তায়’।

হ্যাঁ! সুবোধ তো ঐ কয়েকটা দিন রাস্তাতেই ছিল। সেই সুবোধগুলোকেও শেষপর্যন্ত ঘা খেয়ে পালাতে হয়েছে। কারণ “পাপবোধ (এখনও) নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে।“ সুবোধকে তাই আবারও পালাতে হয়েছে। আর কত পালাবে সুবোধ? কবে আসবে সময় পক্ষে? সময় পক্ষে আসতে পারে। সেজন্য সময়টাকে বুঝে নেওয়াটাও মনে হয় জরুরি। এই সময়ে এমন সমাজ-পরিবেশ কিভাবে গড়া যায় যেখানে সুবোধকে পালিয়ে বেড়াতে হবে না? সুবোধের ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়বে? সব কিছু নষ্টদের দখল থেকে আবার ফিরে আসবে সুবোধের দ্বারে? মুক্তির নিশান-স্বরূপ সূর্যটা আবার খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিতে পারবে সুবোধ? ভোরের অপেক্ষায় থাকা মোরগটা ডেকে উঠবে তীব্র স্বরে? সুবোধও তার কোলের পাশে বসে থাকা কিশোরী মেয়েটিকে বলবে, ভোর হয়ে গেছে রে পাখি! ও যে আকুল হয়ে জানতে চায়, “সুবোধ! কবে হবে ভোর?”

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দিতে হবে নতুন দৃষ্টি। আর এখানেই আসে প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স বা প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি প্রসঙ্গ। অচেনা দাগ বইয়ে এর ইতিহাস-ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন।

বিষয়টির মূল বক্তব্য হচ্ছে, যেরকম সমাজ আমরা কামনা করি, আকাঙ্ক্ষা করি—তেমন সমাজ নির্মানের লক্ষ্যে কর্মতৎপরতাটাও হতে হবে সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজের আদলে। ১৯ শতকের অরাজপন্থী James Guillaume বলেছিলেন, “একটা কর্তৃত্বপরায়ন সংগঠন থেকে কিভাবে দেওয়া যেতে পারে সাম্য ও মুক্তির সমাজ গড়ার ডাক? এটা অসম্ভব।” ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো তো এই কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে বারবার… বারবার। ২০১১ সালের অকুপাই মুভমেন্টে খুব বড় করে উঠেছিল এই প্রিফিগারেটিভ পলিটিক্স সংক্রান্ত কথাবার্তা।  David Graeber দের লেখালেখি দিয়ে।

ভীষণরকমের কর্তৃত্বপরায়ন, পুরস্কার-তিরস্কার-বহিস্কারে মত্ত ও অভ্যস্ত; এমন সংগঠন থেকে শোনা যায় গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান। দেশের সব রাজনৈতিক দল; সেটা ডানই হোক আর বামই হোক। যে বাদই হোক, যে তন্ত্রই হোক—সংগঠন বানানোর সময় প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি লাগবেই। এমনকি পাড়ায় ১০ জন মিলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকগোষ্ঠী কমিটি করলেও সেখানে থাকে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি। এই ফরম্যাটের বাইরেও যে কোনো সংগঠন হতে পারে— এই জিনিসটা যেন ভাবতেই পারি না আমরা।

নতুন সমাজটা যদি আমরা সাম্যেরই চাই, স্বাধীনতারই চাই—তাহলে এখনকার সংগঠনেও সেটা প্র্যাকটিস করব না কেন আমরা? প্র্যাকটিস করতে গিয়ে অনেক ভুল হবে; সেই ভুল থেকে শেখাও হবে — নতুন সমাজের রূপটা আরও মূর্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনে কতজন সদস্য থাকে? ৪০-৫০ জন সর্বোচ্চ? এই কয়জন মানুষ মিলে সম্মিলিতভাবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না?

যায়। ইচ্ছা থাকলে যায়। কিন্তু ইচ্ছাটাই বোধহয় হয় না কারও। কারণ ইচ্ছা হতে থাকলেই বেরিয়ে আসবে তাদের অনেক অজানা ইতিহাস। উঠতে থাকবে অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গ। সেগুলোর মুখোমুখিই হয়তো হতে চান না তারা। সংগঠনে কোনো কর্মী এসব কথা তুললেও তাই অনেককে পড়তে হয় বহিস্কারের মুখে। নিদেনপক্ষে তিরস্কারের মুখে। তিরস্কার শুনে যারা আবার সামলে নেন, লাইনে হাঁটেন—তাদের সামনে থাকে পুরস্কারের হাতছানি। এই করেই চলছে সংগঠনগুলো।

কিন্তু সুবোধের উপযোগী একটা সমাজ যদি আমরা গড়তে চাই; তাহলে আমাদের বেরোতে হবে এই চিরাচরিত চিন্তাভাবনাগুলো থেকে। করতে হবে নতুনের সন্ধান। পুরাতনকেও আবিস্কার করতে হবে নতুন করে। সুবোধ যেমন নতুন কিছু নিয়ে হাজির হয়েছে- তেমনি পরিবর্তনকামী প্রতিটি মানুষকে সক্রিয় হতে হবে। অন্ততপক্ষে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে।

কেন্দ্রীয় একটা কমিটি, পদাধিকার বলে নেতা, নেতার হাতা, অনেকগুলো মুখের একজন পাত্র; (যিনি শুধু মাইকে হুমহাম করবেন আর আমাদের-মামুদের ইচ্ছেমতো ফুল-পাতা-পায়রা ওড়াবেন, মোম জ্বালাবেন) ইত্যাদি হওয়া ছাড়াও আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হতে পারে। সফল আন্দোলন-সংগ্রাম হতে পারে। ২০০৮ সালে রাবিতে কর্তৃত্ববিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ মঞ্চের কর্মী হিসেবে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, একক কোনো নেতা বা নেতার বিশেষ ক্ষমতা বা কোনো কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও কিভাবে একটা আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এবং সেটা দারুণভাবে সফল হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত পরিসর তৈরি করতে পারে। সূত্র.bn.bangla.report