সাতক্ষীরায় গরুর খামার বদলে দিয়েছে জেয়ালা গ্রামের ভাগ্য

0
1238

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি :
সাতক্ষীরার দুগ্ধ শিল্প সারাদেশে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। দিন দিন জেলাতে নতুন নতুন দুগ্ধ খামার গড়ে উঠছে। কম খরচে অধিক মুনাফা আসায় লক্ষাধিক নারী-পুরুষ এ পেশা বেছে নিয়েছে। অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করেছেন। জেলাতে ছোট বড় প্রায় ১০ হাজার দুগ্ধ সমবায়ী ও খামার গড়ে উঠেছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণে দুধ বিভিন্ন জেলাতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে খামারিরা বিপুল টাকা উপার্জন করছে। অনেকে শুধু গো খামার করে স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন। বর্তমানে শিক্ষিত যুবকেরা গাভী পালনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এতে দারিদ্র দূরীকরণ সহ ব্যাপক পুষ্টির চাহিদাও মিটানো সম্ভব হচ্ছে।
জেলা পশু সম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় বর্তমানে ১ হাজার ৫৫টি দুগ্ধ খামার রয়েছে। তবে বেসরকারী হিসাবে এর সংখ্যা আরো বেশি। এসব খামারে উন্নত জাতের গাভী রয়েছে প্রায় সাত থেকে আট হাজার। এসব খামার থেকে বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতি মাসে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে এক লাখ লিটারের বেশি দুধ মিল্কভিটা, প্রাণ, ব্র্যাক, আড়ংসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সরসরি খুলনা ও যশোরের ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করা হয়।
এসএসসি পাস করি ১৯৮১ সালে। এরপর চাকরির পেছনে ঘুরতে ঘুরতে দু’টি বছর পার হয়ে যায়। পরে চাকরি না পেয়ে ১৯৮৩ সালে ৬ হাজার টাকা ধার করে একটি বিদেশি গাভী (বকনা) ক্রয় করি। এক বছর পরেই তার গর্ভে একটি বাছুর জন্ম নেয়। এরপর বাড়তে শুরু করে গরু। এভাবে বাড়তে বাড়তে সুচিত্রা ডেইরি নামে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলি একটি দুগ্ধ খামার। বর্তমানে খামারে রয়েছে ৫০টি গরু। এ খামারে প্রতিদিন প্রায় ৩শ’ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে।’ এভাবে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানোর বর্ণনা দিলেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রামের মৃত কালিপদ ঘোষের পুত্র প্রশান্ত ঘোষ।
তিনি জানান, বর্তমানে তার দেখাদেখি ওই গ্রামে গড়ে উঠেছে আরও ছোট বড় প্রায় ১৩৭টি দুগ্ধ খামার। এসব খামারে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। খামারিরা জেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় দুধের চাহিদা মিটিয়ে আসছেন। এ দুধ বিক্রি করে এখানকার মানুষের ভাগ্যের চাঁকা ঘুরছে। ফলে এ পাড়া এখন জেয়ালা দুগ্ধপল্লী নামে পরিচিতি পেয়েছে। তবে এখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যা রয়েছে। যে কারণে অনেক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে এখানকার মানুষ।
গাভী পালনে স্বাবলম্বী তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের জেয়ালা ঘোষ পাড়ার জ্ঞানেন্দ্র নাথের পুত্র দিবস ঘোষ । তিনি গাভী পালন করে ৩ বার জাতীয় পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন । বর্তমানে তার দুগ্ধ খামারে গাভীর সংখ্যা ৪২ ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেয়ালা ঘোষ পাড়ার দিবস ঘোষ বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তুলেছেন দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামার । তিনি ১৯৮০ সালে ৪ টাকার বিনিময়ে ১টি ছাগল ক্রয় করেন । এই ছাগল থেকে প্রায় ১৫০টি ছাগল বৃদ্ধি করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে গাভী পালন শুরু করেন। তিনি প্রথমে দেশীয় ৩টি গাভী বিক্রয় করে ৮হাজার ৪০০ টাকার বিনিময়ে ১টি বিদেশী গাভী ক্রয় করেন । ১টি গাভী থেকে ক্রমানয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার খামারে ৬৫টি গাভী হয় । সেখান থেকে তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকার অধিক দামে ২০টি গাভী বিক্রয় করে জমি ক্রয় করেন। বর্তমানে তার খামারে গাভীর সংখ্যা ৪২। এর মধ্যে ১৭টি গাভী হতে দৈনিক ২হাজার ৪০ লিটার দুধ দিচ্ছে। প্রতি কেজি দুধ বিক্রি হচ্ছে ৩৫টাকা দরে। গাভী পালন করে খরচ বাদে তিনি প্রতি বৎসর ৩/৪ লক্ষ টাকার অধিক মুনাফা অর্জন করেন ।
দিবস ঘোষ নিজের প্রতিদিন ৫ মণ দুধ উৎপাদনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ঘোষপাড়ায় প্রায় দুই হাজারের মতো ছোট-বড় গরুর খামার রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ১৩শ’ গাভী। এখানকার মানুষ দুগ্ধ খামারের ওপর নির্ভরশীল। এখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে বসবাস করছে মানুষ।
তালা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার জেয়ালা গ্রাম। এই গ্রামের ঘোষপাড়ায় ১৫০টি পরিবারে প্রায় এক হাজার লোকের বসবাস। মানুষের প্রধান কাজ কৃষি ও গরু পালন। এখানে রয়েছে ১৩৭টি দুগ্ধ খামার। খামারগুলোতে জার্সি, ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল, হরেস্টানসহ বিভিন্ন জাতের গরু রয়েছে। এরমধ্যে জার্সি, ফ্রিজিয়ান ও শাহিওয়াল গরুর সংখ্যা বেশি। এখানে যত গরিব পরিবারই থাকুক না কেন তাদের কম পক্ষে ৩ থেকে ৪টি গরু রয়েছে। আর অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের রয়েছে ৫ থেকে ৫০টি গরু। এমনও পরিবার আছে প্রতিদিন ৬ মণ দুধ বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে এখানে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। যা সাতক্ষীরার বিনেরপোতা, খুলনায় ব্র্যাকের আড়ং, আঠারমাইল ও জাতপুরে প্রাণসহ বিভিন্ন কারখানায় বিক্রয় করা হয়। সকাল থেকে বিকেলের দুধের দাম বেশি পায় খামারিরা। নিজস্ব তত্ত¡াবধানে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে কারখানাগুলোতে দুধ পৌঁছে দিতে হয় খামারিদের। আর গো-খাদ্যের জন্য খামারিদের প্রায় ২০ একর জমিতে রোপিত আছে হাইব্রিড নেপিয়ার, প্যারা ও ইপিল ইপিল ঘাস। সেখান থেকে ঘাস কেটে খাওয়ানো হয়।
ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, জেয়ালা ঘোষপাড়ায় ঢুকতেই চোখে পড়ে শুধু গরু আর গরু। দেশি-বিদেশি মোটা বিভিন্ন প্রজাতির গরু-বাছুরে পাড়াটি ভরা। দেখলে মনে হবে এটি যেন পাড়া নয়, গোচারণ ভূমি। নারী-পুরুষ সকলে রয়েছে গরুর সেবায় ব্যস্ত। কেউ কাটছে ঘাস, কেউ বিচালি (খড়), আবার কেউবা গরুর গা ধোয়াচ্ছেন। যেন কথা বলার সময় নেই কারও। কারণ সময়মতো দুধ নিয়ে যেতে হবে কারখানায়। দুধ নিয়ে কেউ যাচ্ছে বাইসাইকেলে, কেউ যাচ্ছে নছিমন-করিমনে। পরিবারের প্রায় সব সদস্যই এই খামারের সঙ্গে জড়িত। অক্লান্ত পরিশ্রমে তারা সরকারিভাবে এখানে দেওয়া হয়নি তেমন কোনো বরাদ্দ। পশু কর্মকর্তাদের প্রতি খামারিদের রয়েছে নানা অভিযোগ। এর পরও কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ঠিকমতো তাদের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন বলে ভুক্তভোগী খামারীরা জানান। তবে নিজেদের প্রয়োজনে গ্রামবাসী প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন।
এদিকে দুগ্ধ বহন ও সংরক্ষণে রয়েছে খামারীদের নানা অভিযোগ। প্রায়ই দুগ্ধ বহনকারী গাড়ি নষ্ট হওয়ায় খামারীদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। সংরক্ষনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হয়ে যায় প্রায় ২ লাখ ৫২ হাজার টাকার অধিক দুধ। সরকারীভাবে দুধ সংরক্ষণ করতে পারলে খামারীরা আরো বেশি লাভবান হত।

অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে মিল্ক ভিটার দুগ্ধ শীতলকরন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে.
সাতক্ষীরার বিসিক শিল্প নগরিতে ২০০৫ সালের ২৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় মিল্ক ভিটার দুগ্ধ শীতলকরন কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠার পরে কেন্দ্রে ৩০টি সমবায় সমিতি নিবন্ধিত হয়ে নিয়মিত দুধ সরবরাহ করতো। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ বর্তমানে মিল্কভিটার স্থানীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের দুধের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করে।
দেশের প্রতিটি মিল্ক ভিটা কেন্দ্রের ল্যাবটারিতে আধুনিক পদ্ধতিতে এনালাইজার ম্যাশিনের মাধ্যমে দুধের ফ্যাট পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। মূলত দুধের সেই ফ্যাটের উপরেই লিটার প্রতি মূল্য নির্ধারন হয়ে থাকে। কিন্তু সাতক্ষীরা বিনেরপোতা বিসিক শিল্প নগরিতে অবস্থিত মিল্কভিটা দুগ্ধ শীতলিকরণ কেন্দ্রে দুধ পরীক্ষাকরা নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। খামারি ও সমবায়ীদের বক্তব্য আধুনিক এনালাইজার পদ্ধতিতে দুধের ফ্যাট পরীক্ষায় প্রতি লিটার দুধে থাকা চার দশমিক সাত পয়েন্ট ফ্যাট নির্ধারণ হয়ে থাকে সাধারণত। কিন্তু সেখানে তার পরিবর্তে চার দশমিক শূন্য বা তার কাছাকাছি পয়েন্ট করে দেন ল্যাব টেকনিশিয়ান ।
এতে দুধের মান খারাপ দেখিয়ে দাম কম দেয়া হচ্ছে তাদের। ফলে ৪.৭ পয়েন্ট দুধের ফ্যাট বা ননি অনুযায়ী ১ লিটার দুধের মূল্য দাঁড়ায় ৪৩ টাকা। কিন্তু সেখানে সনাতন পদ্ধতিতে ৪.০ পয়েন্ট দুধের ফ্যাট বা ননি অনুযায়ী মাপের এই তারতম্য দেখিয়ে লিটার অনুযায়ী দাম দিচ্ছে ৩৮ টাকা। ফলে প্রতি লিটার দুধে ৫ টাকা করে ঠকানো হচ্ছে বলে খামারিদের অভিযোগ। এমন দাম দেয়া হতো বিগত বছর গুলোতে তবে বর্তমানে দুধের দাম দেয়া হচ্ছে ৫৫ টাকা দরে।
সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও খামারিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে এ খাত জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।