সবুজের বুকে মৌরি ফুলের হলুদ শোভা

0
1094

আজিজুর রহমান, ডুমুরিয়া থেকে ফিরে :
খুলনা নগরের জিরোপয়েন্ট মোড় থেকে মহাসড়ক দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পথ পার হয়ে কিছুটা এগোলেই ১৮ মাইল সড়ক। ওই সড়ক ধরে এগিয়ে জাতপুর যেতেই দেখা মেলে দিগন্তজোড়া সবজির খেত। সেখানে একপা দুপা হেঁটেই বাঁধাকপি ও ফুলকপির মধ্যে মৌরির হলুদ রঙের আভায় চোখ আটকে যায় সবার। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সবুজের বুকে মৌরি ফুলের হলুদ শোভা।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় একই সঙ্গে বাঁধাকপি, ফুলকপি ও অন্যান্য ফসলের সাথী ফসল হিসেবে মৌরির চাষ করেছেন কৃষকরা। স্বল্প সময়ে অধিক পরিমাণ আয় করা সম্ভাব বলে মৌরি চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে এই উপজেলার কৃষকের কাছে। মৌরি মূলত মসলা জাতের ফসল। এটি সকল প্রকার মাটিতে চাষের উপযোগি। তবে বেলে দোঁ-আশ মাটি হলে ফলন ভালো হয়। একর প্রতি কমপক্ষে ৩০০ কেজি থেকে ৬০০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। এলাকাভেদে প্রতি কেজি কমপক্ষে ৭০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত দাম পাওয়া যায় বলে মন্তব্য করেন কৃষি কর্মকর্তারা।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে, মৌরির বীজবপণের উপযুক্ত সময় আশ্বিন থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত। এই সময় একর প্রতি চার থেকে সাড়ে চার কেজি বীজ ৪ থেকে ৫ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে সারিতে (৪৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে) অথবা ছিটিয়ে বোনা যেতে পারে। উপজেলার ছোট বড় মিলে প্রায় ২৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের মৌরির কমপক্ষে ২০০ মৌরি চাষের খেত রয়েছে। এরমধ্যে এস ৭, এস ৮, এস ৯, বারি ১ ও ২, পিএফ ৩৫, কো ১ এবং গুজরাট জাতের মৌরি চাষ উল্লেখযোগ্য।

উপজেলার বরাতিয়া ব্লকের উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. ইখতেহার হোসেন জানান, মৌরির ফল বা বীজ মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের মাছ-মাংসের তরকারি, আচার, পিঠা ও নানান রকমের মিষ্টি খাবারে মৌরি ব্যবহৃত হয়। পান মসলা হিসেবেও খুব জনপ্রিয়।

মৌরির আরও অনেক নাম রয়েছে অঞ্চলভেদে। কোথায় গুয়ামুরি, কোথাও মহুরি নামে পরিচিত। এর গাছ দুই থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ফুল দেখতে অনেকটা খোলা ছাতার মতো। সাধারণত ফুলের রঙ হলুদ আর শাদা হয়ে থাকে। পাতাগুলো চিরল, মসৃণ এবং পাখির পালকের মতো হয়।

সাত বিঘা জমিতে মৌরি চাষ করেন ডুমুরিয়ার মাগুরঘুনা ইউনিয়নের আরশনগরের কৃষক ইয়াসিন মোড়ল। তিনি বললেন, বাঁধাকপি ও ফুলকপির সাথী ফসল হিসেবে মৌরি চাষ করায় তেমন কোনো খরচ হয়নি। মৌরির জন্য আলাদা কীটনাশকের ব্যবহার প্রয়োজন হয় না। খেতের মৌরি এখন বিক্রিয় উপযোগি হয়ে ওঠেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহাজনেরা মৌরি কিনতে খেতে এসে দাম কষাকষির মাধ্যমে চূড়ান্ত করছে। সপ্তাহখানকের মধ্যে খেত থেকে মৌরি তুলে নিয়ে যাবেন তাঁরা।

মৌরির ফলন ভালো হওয়ায় ভীষণ খুশি আরশনগরের সেলিমুল ইসলাম নামের আর একজন কৃষক। এ বছর তিনি পাঁচবিঘা জমিতে মৌরির চাষ করেছেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি। সেলিমুল বলেন, জমির কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য এলোমেলো ব্লক নকশা ব্যবহার করে শীতকালীন সবজির সাথী ফসল হিসেবে মৌরি চাষ লাভজনক। তাছাড়া মৌরির উৎপাদন খরচ যেমন কম তেমনি লাভও বেশি। বিঘাপ্রতি ৬ থেকে ৮ মণ মৌরি উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য মণ প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন খুলনাটাইমসকে বলেন, ডুমুরিয়ার কৃষকেরা উচ্চ চাহিদা ও ভালো বাজার মূল্যের জন্য মৌরি চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেছে। তাই অন্যান্য সবজি চাষের পাশাপাশি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে মৌরি চাষ। বহুল পরিচিত সুগন্ধযুক্ত উচ্চমূল্যের মশলাদার ফসল মৌরি দৈনন্দিন রান্নার অনেকখানি জুড়ে আছে। কৃষকের খেত ভরে এখন মৌরি ফুলের দৃষ্টনন্দন দৃশ্য আর ঘ্রাণ বাতাসে ভাসছে। পাঁচ ফোঁড়নের এক ফোঁড়ন মৌরি। বহুগুণে গুণান্বিত এই মসলা।

তিনি আরও বলেন, মৌরিতে প্রচুর পরিমাণে ঔষধি গুণও বিদ্যমান। খনিজ লবণ সমৃদ্ধ বীজ মৌরি, ঔষধি এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে সোডিয়াম, আয়রণ, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, কপার, জিঙ্ক, তামা, ভিটামিন এ, সি, ই ও ভিটামিন বি প্রচুর পরিমানে আছে। এতে আরো আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফ্ল্যাভনয়েড। এছাড়া মৌরির আঁশ সমৃদ্ধ হওয়ায় বিভিন্ন রোগের পথ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।