সচেতনতাই সিলিকোসিস প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার

0
857

মো. আকতারুল ইসলাম: ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস, স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, সর্দি, কাশি, জ্বর সবসময় লেগে থাকা, শরীর দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়া, ওজন কমে যাওয়া এবং এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। এ লক্ষণগুলো একজন সিলিকোসিস রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়। সিলিকোসিস শব্দটি খুব পরিচিত নয়, এটি একটি মরণব্যাধি। সিলিকোসিস এক ধরনের ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ। সাধারণত পাথরভাঙা শ্রমিকদের এ রোগ হয়ে থাকে। পাথরের উপাদান সিলিকা (স্ফটিকের ধুলো) থেকে এ রোগ হয় বলে একে সিলিকোসিস বলা হয়। সিলিকা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহের ফুসফুসে প্রবেশ করে। ফুসফুসের সূক্ষ ছিদ্রগুলোকে বন্ধ করে দেয়।

পাথরের ধুলিকণা নাক, মুখ এমনকি চোখের মধ্যদিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ফসফুস ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আক্রান্ত ব্যক্তি দিনে দিনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে সিলিকোসিস রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। ব্যক্তি সচেতনতাই এ রোগ প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার।

সিলিকোসিস তিন ধরনের হতে পারে- সাধারণ সিলিকোসিস/হালকা সিলিকোসিস- ধুলোর মধ্যে কাজ করলে ১০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এ রোগে আক্রান্তকে শনাক্ত করা কঠিন। তবে এক্ষেত্রে, অব্যাহত খুসখুসে কাশি এবং শ্বাসকষ্টজনিত চিনচিনে ব্যাথা হতে পারে। বর্ধমান সিলিকোসিস সিলিকার ধুলোর মধ্যে কাজ করলে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এটিও সাধারণ সিলিকোসিসের মতোই। তবে এর সংক্রমণ দ্রুততার সাথে জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তৃতীয় ধরণটি জটিল সিলিকোসিস। এটি জটিল আকার ধারণ করে যখন ফুসফুসের বায়ু কুঠুরিগুলো যুক্ত/ স্ফিত হয়ে এক সেন্টিমিটার বা তারও বেশি বড়ো হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের খুব সমস্যা হয়। এ সময় যক্ষ্মা ও ছত্রাক সংক্রমণের মতো রোগগুলো একে আরো জটিল করে তুলতে পারে। এ সমস্যা ধীরে ধীরে ফুসফুসের ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে।

এগুলোর বাইরে যেটি মারাত্মক এবং প্রাণঘাতি তা চরম সিলিকোসিস। পাথরগুড়া বা পাথরের ধুলা শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করার কারণে কয়েক সপ্তাহ থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়লে তাকে একিউট সিলিকোসিস বলে। চরম সিলিকোসিসে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, কাশি ও দুর্বলতা বাড়ায় এবং ওজন কমে যায়- এ অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। এ রোগে বেসরকারি হিসাব মতে, এখন পর্যন্ত ৬৭ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, সিপাইপাড়া, ভোজনপুর, জগদল, ময়নাকুড়ি এলাকা, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর বিভিন্ন এলাকায় শিলপাটা তৈরির কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত।

পাথরভাঙা শ্রমিকদের মাঝে সিলিকোসিস আক্রান্তের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১২ সালে। সে সময় লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরের সিলিকোসিসে আক্রান্ত ৫৩ জন শ্রমিকের সন্ধান পান জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞরা। বক্ষব্যাধি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃতপক্ষে সিলিকোসিসের কোনো চিকিৎসা নেই। এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা প্রতিরাধ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। যাতে সিলিকা ধোঁয়া সঠিক উপায়ে নিগর্মন হয়। এই রোগে আক্রান্ত একজন শ্রমিকের শ্বাস-প্রশ্বাসের সংস্পর্শে না আসা, শ্রমিকের ব্যক্তিগত সচেতনতা ও মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করাও এ রোগ প্রতিরোধের অংশ হতে পারে।

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে বুড়িমারী স্থলবন্দরে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা পাথরভাঙা কারখানাগুলোয় সিলিকোসিস রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। ভারত ও ভুটান থেকে আমদানি করা বোন্ডার পাথর, লাইমমেটালসহ বিভিন্ন ধরনের পাথরভাঙার সময় প্রচুর পরিমাণে সিলিকা কণা তৈরি হয়। এগুলো শ্রকিকের সারাদেহ ঢেকে দেয়। মাঝে মাঝে ধোঁয়ার পরিবেশ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পানি ব্যবহৃত হয়। তবে পানি ব্যবহারে উৎপাদিত পাথরের গুণগতমান নষ্ট হওয়ার অজুহাতে মলিকপক্ষ তা করতে দেয় না। এতে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। জয়পুুরহাটের আক্কেলপুরে শিলপাটা তৈরির কারখানায় কাজ করতে গিয়েও সিলিকোসিসে প্রায় অর্ধশত লোকের মৃত্যু হয়েছে।

পাথরভাঙা শ্রমিকদের সিলিকোসিস সম্পর্কে সচেতন করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ লেবার স্টাডিজ (বিলস) কাজ করছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, লালমনিরহাটের স্থানীয় প্রশাসন, সিভিলসার্জন অফিস, একসাথে কাজ করছে। সিলিকোসিস রোগের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে বিলস এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল যৌথভাবে গবেষণা করছে। বেসরকারি সংস্থা সেইফটি এন্ড রাইটস সোসাইটি বুড়িমারীর পাথর শ্রমিকদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যক্যাম্প পরিচালনা করছে।

পাথরভাঙা শ্রমিকদের সিলিকোসিস থেকে বাঁচাতে মালিক-শ্রমিকের ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাস্ক ছাড়া কোনোক্রমেই কাজ করা উচিত নয়। সেইসাথে কারখানা মালিককেও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মালিককে আরো যে বিষয়গুলো দেখতে হবে পাথরভাঙার মেশিনগুলো জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে হবে। কোনো মতেই খোলাস্থানে কোনো পাথরভাঙতে পারবে না এবং পাথর ভাঙ্গার সময় পাথরে পর্যাপ্ত পানি ঢালতে হবে। কারণ পাথরের ধুলায় শুধু শ্রমিকই নয়, এলাকার লোকজনও ঝুঁকিতে থাকে।

পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে বড়ো ভূমিকা রাখতে হবে। শ্রমিকের বিশেষ পোশাক ও মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত প্রতিষেধক ঔষধ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। পদক্ষেপগুলো শুধু বুড়িমারীতে কিংবা তেঁতুলিয়াতেই নয়, যেখানে পাথর ক্রাশিং হয় সেখানেই নিতে হবে।

সিলিকোসিস প্রতিরোধের বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ডা. আনিসুল আওয়াল বলেন, পাথরভাঙার কাজ কোনো মালিকই কোনোভাবেই বাইরে করতে পারবে না। কারখানা ঘরের মধ্যে করতে হবে। তবে তিনি সবচেয়ে যে বিষয়টির ওপর জোর দেন তা হলো পাথর ভাঙার সময় পর্যাপ্ত পানি ঢালতে হবে। যেখানে পাথর ক্রাশিং হবে সেখানেই ঝর্ণার ব্যবস্থা করতে হবে। আর কারখানার ভেন্টিলেশনের মাথায় এক্সজাস্ট ফ্যানের সাথে ঝর্ণার পানির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বাতাসে ডাস্ট মিশতে না যেতে পারে। মাস্ক অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। শ্রমিকরা না ধুয়ে কোনো মাস্ক ব্যবহার করতে পারবে না।

সিলিকোসিস মরণব্যাধি, এর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন এবং মালিকগণ দায়িত্বশীল থেকে একইসাথে মালিক শ্রমিক সকলের মধ্যে ব্যক্তিসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকা পাথর শ্রমিক এবং কারখানার আশপাশের অন্যান্য মানুষগুলোর জীবন বাঁচবে। সচেতনতাই সিলিকোসিস প্রতিরোধের মূল হাতিয়ার।

(পিআইডি প্রবন্ধ)