শত বছরের পাদুকা খড়ম বৃদ্ধদের কাছে শুধুই স্মৃতি

0
3079

ফকির শহিদুল ইসলামঃ
মাটিতে পা ফেললেই ধুলোবালি লেগে পা কেন ময়লা হবে আর তা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ই বা কি? সারারাত ভেবে ভেবেও এ সমস্যা সমাধানের কোন কূল কিনারা পেলেন না রাজা হবুচন্দ্র। পরদিন সকালে রাজা নির্দেশ দিলেন মন্ত্রী গবুচন্দ্রকে ময়লা হওয়া থেকে রাজার পা’কে রক্ষা করার উপায় বার করতে হবে যথশীঘ্র সম্ভব।মন্ত্রীবর্গ, সভাসদ , পন্ডিত , বিজ্ঞানী সবাই ব্যাপক গবেষনা করেও রাজার সে সমস্যা সমাধানের যখন কোন কুল কিনারা করতে পারছিলেন না, তখন একজন চর্মকার এসে চামড়া দিয়ে রাজার পা ঢেকে দিয়েছিলেন আর তখন থেকে পৃথিবীতে জুতা পরার প্রচলন শুরু হয়েছিল । জুতা আবিস্কারের সে গল্প, কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের “জুতা আবিস্কার” কবিতার বদৌলতে আমরা জানতে পারি পাদুকার বৈচিত্র ।
স্বধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে অনেকেই ব্যবহার করতেন কাঠের পাদুকা বা খড়ম। আশির দশকেও গ্রাম গঞ্জের বৃদ্ধেদর পায়ে দেখা যেত কাঠের তৈরি এ খরম (পাদুকা)। এখন তেমন আর ব্যবহার হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশে খড়মের ব্যবহার অনেক প্রাচীন।ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় ১৩০৩ সালে বিখ্যাত সুফি দরবেশ ও পীর হজরত শাহজালাল (রহ.) সুদূর তুরস্ক থেকে সিলেটে এসেছিলেন খড়ম পায়ে দিয়ে। তার ব্যবহৃত খড়ম এখনও তার সমাধিস্থল সংলগ্ন স্থাপনায় রক্ষিত আছে।

কিছুকাল আগেও গ্রামের বাড়িতে খড়মের শব্দে গৃহস্থরা বুঝতে পারতেন তাদের বাড়িতে কেউ আসছেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঠের তৈরি পাদুকা খড়ম এখন আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতি। কালের আবর্তে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কাঠের পাদুকা খড়ম। এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।আধুনিক সভ্যতার বিবর্তনের ফলে সাধারন মানুষ এখন ব্যাবহার করছেন আধুনিক মেশিনদ্বারা তৈরি চামড়া, রেকসিন, প্লাস্টিক, কাপড়,পাট দিয়ে তৈরি জুতা । নিত্যনতুন ডিজাইনের তৈরি জুতা পায়ে অভ্যস্থ হওয়ার ফলে হারিয়ে গেছে কাঠের পাদুকা বা খড়ম। নতুন প্রজন্ম জানেনা যে তাদের দাদুরা জৌবনকালে তাদের পায়ে শোভা পেতো কাঠের পাদুকা বা খড়ম। শোভা বর্ধন কারী এসব পাদুকা হারিয়ে যাওয়ার সাথে আমরা নিত্য নতুন জুতা,স্যান্ডেল পায়ে দিচ্ছি । সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় হয়েছে বার্মিজ জুতা।দেশের নগর-মহানগর, শহর- এমনকি গ্রাম বাংলার মানুষের পায়ে পায়ে এসব জুতা এখন শোভা বর্ধন করে।

জানা যায়, কাঠ দিয়ে তৈরি খড়ম পরিবেশবান্ধব। তারপরও মানুষ এটিকে পরিহার করেছে। অপরদিকে বার্মিজ জুতা মানুষের মাথা গরম করা, পায়ের নিচের স্তরের চামড়া মোটা করে বয়রা নামক রোগের সৃষ্টি করে। বয়রায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছেন।৯২ বছর বয়সী প্রবীণ আজাহার আলী জানান, ৭০ এর দশক পর্যন্তও জনপ্রিয় পাদুকা ছিল খড়ম। তবে সে সময় পশুর চামড়ায় তৈরি জুতাও কম-বেশি ছিল। পরে যানবাহনের চাকায় ব্যবহৃত টায়ার ও টিউব কেটে তৈরি হয় এক ধরনের জুতা। যার নামকরণ করা হয় টায়ার জুতা। কালের আবর্তে ওই টায়ার জুতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর পরে পরে আসে আধুনিক স্যান্ডেল। বর্তমানে বাহারি মডেলের আধুনিক সেন্ডেলে বাজার সয়লাব। একটি কাষ্ঠ পাদুকা খড়ম তৈরি করতে (মজুরি ও কাঠের দাম বাবদ) বর্তমান বাজারে খরচ পড়ে ৫০ থেকে ১শ’ টাকা। পক্ষান্তরে বার্মিসের একটি পাদুকা পাওয়া যায় মাত্র ৮০ থেকে ১শ’ টাকায়। তিনি আরো জানান, বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের তৈরি জুতার পাশাপাশি বার্মিস জুতা ব্যবহার করতে হয়। খড়ম পায়ে দিয়ে চলাফেরা করলে বর্তমান যুগের মানুষ মিসকিন বা মান্ধান্তা যুগের পাদুকা ব্যাবহার বেমানান মনে হবে বিধায় ইচ্ছা থাকলেও খড়ম ব্যবহার করি না। আধুনিিকতার ছোয়ায় আমাদের শত শত বছরের পাদুকা খড়ম বিলুপ্ত ।