লঞ্চ দুর্ঘটনা

0
330

বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই মর্মান্তিক ও দুঃখজনক লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর মিলেছে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে। রাজধানীর বুকে ফরাশগঞ্জের শ্যামবাজারের সন্নিকটে দিনদুপুরে ঘটেছে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা। মুন্সীগঞ্জের কাটপট্টি থেকে সোমবার সকালে এমএন মর্নিং বার্ড আসছিল রাজধানী অভিমুখে। ফরাশগঞ্জ অতিক্রমকালে এমভি ময়ূর নামে আরেকটি লঞ্চ অকস্মাৎ ধাক্কা দিয়ে উপরে উঠে যায় মর্নিং বার্ডের। মাত্র ৯ সেকেন্ডের মধ্যেই তলিয়ে যায় লঞ্চটি। সলিল সমাধি ঘটে শতাধিক যাত্রীর। নৌ, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় অন্তত ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্য, ভয়াবহ ও মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার জন্য দুই লঞ্চের সারেং ও সহকারীরাই দায়ী। তবে ঘটনাস্থলে সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজে প্রতীয়মান হয় যে, দুর্ঘটনার প্রধান দায় গিয়ে বর্তায় এমভি ময়ূরের ওপর। চাঁদপুর-ঢাকাগামী তিনতলা লঞ্চটিই পেছন থেকে ধাক্কা দেয় ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকে। আরও যা আশ্চর্যের তা হলো, লঞ্চটি জব্দ করা হলেও এর মাস্টার, সহকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাপাত্তা হয়ে যায়। যেটি প্রায়ই প্রত্যক্ষ করা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় চালক ও সহকারীর ক্ষেত্রে। যা হোক, দুর্ঘটনার পর পরই নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের অধীনে অন্তত দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন। নিহত ও আহতদের লাশ দাফনের খরচসহ দেয়া হয়েছে ক্ষতিপূরণ, যা অপর্যাপ্ত। গভীর শোক ও সমবেদনা জানানো হয়েছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। তবে যে প্রশ্নটি সব ছাপিয়ে সামনে আসে তা হলো, প্রকাশ্য দিবালোকে এ রকম একটি ভয়ানক ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটবে কেন? এর দায় নেবে কে বা কারা? নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এটি একটি হত্যাকা। দেশের নৌপথকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়। আর সেখানেই কিনা এহেন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা।
গত ৪৫ বছরের সরকারী পরিসংখ্যান বলছে, ছোটবড় মিলিয়ে ৬৫৯টি নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৭৪১ জনের। নৌপথে প্রতিবছর গড়ে ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পর পরই গণমাধ্যমে লেখালেখি হয়। বিআইডব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। নিহত ও আহতদের হৃদয়বিদারক আহাজারিতে মথিত হয় আকাশ-বাতাস। গঠিত হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। দেয়া হয় ক্ষতিপূরণের আশ্বাস। তবে শেষ পর্যন্ত সবই ধামাচাপা পড়ে যায়। নিহত ও আহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণও মেলে না। সর্বোপরি আলোর মুখ দেখে না তদন্ত প্রতিবেদন। সড়কযানের মতোই নৌ পরিবহন মালিকরাও একজোট, একতাবদ্ধ ও ক্ষমতাবান বিধায় সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেন অবলীলায়। তারপর আবার যে কে সেই। প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হয় আরও একটি নৌ দুর্ঘটনার।
নৌ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয় ফিটনেসবিহীন নৌযানকে। দেশে নৌশিল্প তথা লঞ্চ-স্টিমার এমনকি সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ বর্তমানে একটি গৌরবজনক পর্যায়ে উপনীত হলেও সড়কযানের মতো ফিটনেসবিহীন অনেক নৌযানের খবরও আছে। যেগুলো স্বল্প ব্যয়ে বিধিবহির্ভূত নক্সায় আনাড়ি হাতে অবৈধ ডকইয়ার্ডে তৈরি করা হয়। বাস-মিনিবাসের মতো ধারণক্ষমতার চেয়ে অধিক যাত্রী ও মাল পরিবহনও ওপেন সিক্রেট। সত্যি বলতে কি এসব বিষয়ে আদৌ কোন দেখভাল নেই। এর ওপর রয়েছে অরক্ষিত অনাব্য নৌপথ, ডুবোচর, পর্যাপ্ত বয়া-বাতির অভাব, যত্রতত্র যাত্রী তোলা ও নামানোর প্রতিযোগিতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়ঝঞ্ঝা ইত্যাদি। আশার কথা এই যে, সরকার সম্প্রতি দেশের সব নৌপথ সারা বছর ধরে নাব্য রাখার জন্য খনন তথা ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। নৌপথ নিরাপদ রাখার জন্য গঠন করা হয়েছে নৌ টহল পুলিশ, ফোরশোর গার্ড। এসবই ভাল উদ্যোগ নিঃসন্দেহে। তবে সবার আগে আবশ্যক নৌ চালকের দায়িত্বশীলতা, প্রশিক্ষণ, মানবিকতা, সর্বোপরি নৌযানের ফিটনেস। এসব নিয়মিত দেখভাল করার জন্য বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।