বিদেশ থেকে আসছে না তৈরি পোশাক রফতানির বিপুল অর্থ

0
386

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: তৈরি পোশাক হচ্ছে এদেশের প্রধান রফতানি খাত হচ্ছে। কিন্তু ওই রফতানি আয়ের পুরো টাকা দেশে আসছে না। ফলে দেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ উভয় বাজার থেকেই রফতানি অনুযায়ী অর্থ প্রত্যাবাসন না হওয়ার ঘটনা ঘটছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ক্ষেত্রে বেশি ঘটছে। গত মার্চ-এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৩৮ হাজার ডলার মূল্যের ২২ হাজার পিস টি-শার্ট রফতানি করে নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মূল আমদানিকারক চালানটি গ্রহণ না করায় তা অন্য ক্রেতার কাছে ১০ হাজার ডলারে ছেড়ে দিতে হয়। অর্থাৎ রফতানি চালানটিতে ২৮ হাজার ডলার কম অর্থ প্রত্যাবাসন হচ্ছে। বছর তিনেক আগে চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান ৫ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করলেও অর্থ পরিশোধ হয়নি। তৈরি পোশাক খাত, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক পণ্য রফতানি বার্ষিক ৩ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। তবে রফতানির বিপুল অর্থ দেশে আসছে না। ব্যাংকার ও রফতানিসংশ্লিষ্টদের মতে রফতানি ও প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ব্যবধান থাকতে পারে। কিন্তু তা গড়ে প্রায় ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরও রফতানি ও তার বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির ব্যবধান ছিল ১৬ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তার অধীন সংস্থার মাধ্যমে রফতানি পণ্যের জাহাজীকরণ বা শিপমেন্টের পরিসংখ্যান আধুনিক সফটওয়্যার ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগ্রহ করে। আর এনবিআর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেশের সামগ্রিক রফতানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তাছাড়া রফতানির বিপরীতে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থপ্রাপ্তির হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র জানায়, ইপিবির পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৯ বছরে দেশ থেকে সর্বমোট পোশাক রফতানি হয়েছে ২২ হাজার ৯৪৯ কোটি ডলারের। তার মধ্যে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) কারখানা থেকে রফতানির পরিমাণ ২ হাজার ৮০১ কোটি ডলারের। ওই হিসাবে ইপিজেডের বাইরের কারখানা থেকে সর্বশেষ ৯ বছরে পোশাক রফতানি হয়েছে ২০ হাজার ১৪৮ কোটি ডলারের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী এ পরিমাণ রফতানির বিপরীতে অর্থ এসেছে প্রায় ১৭ হাজার ৩৫৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত ৯ বছরে ইপিজেডের বাইরের কারখানা থেকে পোশাক রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ব্যবধান ৪৭১ কোটি ডলার। গত অর্থবছর ইপিজেডের বাইরের কারখানাগুলো থেকে ৩ হাজার ৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানির বিপরীতে দেশে এসেছে ২ হাজার ৫৩৩ কোটি ডলার। অন্য অর্থবছরগুলোর মধ্যে ২০১০-১১-এ ইপিজেডের বাইরে সারা দেশের কারখানা থেকে পোশাক রফতানি হয়েছিল ১ হাজার ৬১৭ কোটি ডলারের। এ রফতানির বিপরীতে ওই অর্থবছর এক্সপোর্ট রিসিট বা অর্থপ্রাপ্তির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। এ হিসাবে রফতানি ও তার বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্য ছিল ২৬৬ কোটি ডলার বা ১৬ শতাংশের বেশি।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্যের হার হ্রাস-বৃদ্ধির মধ্যে থাকলেও এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর ইপিজেডের বাইরের কারখানা থেকে ২ হাজার ৪৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানির বিপরীতে অর্থ আসে ২ হাজার ৮৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ অর্থবছরটিতে রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির ব্যবধান ছিল ৩৫৮ কোটি ডলার বা ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর পরের অর্থবছর পোশাক রফতানি হয় ২ হাজার ৪৮০ কোটি ডলারের। এর বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১০৮ কোটি ডলার। এ হিসাবে ওই অর্থবছর পোশাক রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির ব্যবধান ছিল ১৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছর ইপিজেড-বহির্ভূত কারখানা থেকে পোশাক রফতানি হয় ২ হাজার ৬৬৪ কোটি ডলারের। এর বিপরীতে অর্থ আসে ২ হাজার ২৫৭ কোটি ডলার, যা রফতানির চেয়ে ৪০৭ কোটি ডলার বা ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ কম।
তবে রফতানির বিপরীতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ অপ্রত্যাবাসিত থাকার সঙ্গে একমত নন পোশাক রফতানিকারকরা। তাদের দাবি, রফতানি ও তার বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্য এত বেশি হওয়া সম্ভব নয়। ডিসকাউন্ট, শর্ট শিপমেন্ট, দুর্ঘটনাসহ সব ধরনের কারণ বিবেচনায় নিয়েও এ ব্যবধান সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হতে পারে।
এদিকে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্টদের মতে, ডিসকাউন্টকেই রফতানি ও প্রকৃত আয়ের পার্থক্যের বড় কারণ বলে মনে করা হয়। এছাড়া অনেক সময় মানহীন পণ্য ফেরত আসে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রেতা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট নেয়। পণ্যের মানের ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। অনেক সময় দেখা যায়, ক্রেতা পণ্য একেবারেই নিতে চাইছে না। তখন দেখা যায় ৩০ শতাংশ ডিসকাউন্টেও রফতানিকারক পণ্য বিক্রি করছে। এতে রফতানি ও প্রকৃত আয়ের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়। মূলত অনেক সময় শর্ট শিপমেন্ট, লেট শিপমেন্ট, ডিসকাউন্ট হয়। এসব কারণে রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য থাকে। তবে এ হার ১৪-১৫ শতাংশ গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্যের হার কত বেশি বা তার হিসাব পদ্ধতি কী, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়মিত বসতে হবে। ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের দেখা উচিত তারা রফতানির পরিমাণ কী পাচ্ছে। কম বা বেশির বিষয়গুলো শনাক্তের পর কারণগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। রফতানি ও অর্থপ্রাপ্তির পার্থক্য কমিয়ে আনার জন্য এ তিন সংস্থার সমন্বিত প্রয়াস জরুরি।
অন্যদিকে বেশি ব্যবধান অসম্ভব বলে মনে করেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক। তিনি জানা, পোশাক পণ্য রফতানির পর মূল্য হ্রাসের সর্বোচ্চ হার ৫ শতাংশ। বিজিএমইএ ইতিমধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এনবিআর, ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। আশা করা যায় এ হিসাবের পদ্ধতি জানার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান জানান, রফতানির বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তির বার্ষিক পার্থক্য বিএফআইইউ যাচাই করে না। রফতানি হলো কিন্তু অর্থ প্রত্যাবাসন হলো না কেন তা দেখা হয় কেস বাই কেস। এসব ক্ষেত্রে রফতানি হয়েছে কিনা, ডিউ ডিলিজেন্স মেইনটেইন হয়েছে কিনা, সেগুলোও দেখা হয়। যেসব কেস সন্দেহজনক, সেগুলোর বিষয়ে এনবিআরকে জানানো হয়। আর ব্যাংকের কেউ জড়িত থাকলে দুদককেও জানানো হয়।