বাস্তবায়ন নেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের

0
348

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: তামাক খাত থেকে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থ্যতায় বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর তামাকের কারণে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬১ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ার পরিকল্পনার কথা বললেও খোদ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের হাতেই একটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানির ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। যে কারণেই সহসাই বাস্তবায়িত হচ্ছে না তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন। তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অগ্রগতি নিয়ে অনুসন্ধানকালে এমন-ই তথ্যচিত্র উঠে এসেছে। তাই একটি তামাক কোম্পানিতে সরকারের যে শেয়ার রয়েছে সেটি প্রত্যাহারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত একটি দেশ গড়ার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কামনা করেছেন বিশেষজ্ঞগণ।
জানা গেছে, ২০৪০ সালের মধ্যে সরকার বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ার পরিকল্পনা করছে। ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তামাক নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের হাতে একটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানির ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এটি অব্যাহত থাকলে ধূমপানমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণে বাধার সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা বাংলাদেশে তামাকের উৎপাদন বন্ধসহ তামাকের বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায় সরকারের শেয়ার প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক বাংলাদেশ ২০১৯’ এর আলোকে ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল-এফসিটিসি’ আর্টিকেল ৫.৩ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী- এবার বাংলাদেশের স্কোর ৭৭, যা গতবার ছিল ৭৮। এক ধাপ এগোলেও তা সন্তোষজনক নয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের ৩৩টি দেশের মধ্যে যে ৩টি দেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে মাত্র জাপান ও জর্ডান।
আর এই হস্তক্ষেপের মূল কারণ হলো- তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার এবং তামাক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে সরকারের উচ্ছপদস্থ কয়েকজনের অবস্থান। তামাক কোম্পানিতে সরকারের অংশীদারিত্বের সুযোগে কোম্পানিগুলোর জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপে হস্তক্ষেপ করা সহজ হয়েছে। এতে জনস্বাস্থ্য ক্ষতির মুখে পড়ছে।
এক জরীপ অনুযায়ী, দেশে তামাকজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু ও অসুস্থ্যতায় বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়, যা তামাকখাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার বিভিন্ন ইস্যুর পাশাপাশি তামাক ইস্যুটিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু রোধ এবং কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি লাঘবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুক- এমনটাই দাবি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মামুন আবদুল কাইউম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের টার্গেট থাকে কিন্তু টার্গেট অনুযায়ী এগুতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের কথা বলেছেন ২০৫০ সালেও যদি দেশ তামাকমুক্ত হয়, তারপরও আল্টিমেটলি আমাদের চাওয়া যেন পূরণ হয়। সরকার যেমন আইটি সেক্টরকে এখন খুব বেশি প্রাইয়োরিটি দিচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণেও যদি এমন প্রাধান্য দেয় তাহলে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহজ হবে।
উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংস্থা ‘এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট-এসিডি’র তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. শাহীনুর রহমান বলেন, সরকার ইচ্ছা করলেই সবই সম্ভব। সরকারের তামাক খাতে রাজস্ব আয় হয় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তামাক ব্যবহারজনিত অসস্থতায় বছরে ব্যয় হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তামাকের কারণে একদিকে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬১ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে অন্যদিকে আবার বছরে এই খাতে দেশের প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। তাই একটি তামাক কোম্পানিতে সরকারের যে শেয়ার রয়েছে সেটি প্রত্যাহারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত একটি দেশ গড়ার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিবে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট-এসিডির মিডিয়া ম্যানেজার আমজাদ হোসেন শিমুল বলেন, বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ না হওয়ায় অনেকাংশেই হোঁচট খেতে হচ্ছে। তাই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকারের অংশীদারিত্ব বিলুপ্ত করে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে।
বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট নামে একটি সংগঠনের তামাক নিয়ন্ত্রন আইনের উপর ‘কমপ্লাইন্স অ্যানালাইসিস-২০১৯’ নামে একটি জরিপে সম্প্রতি জানানো হয়, তামাক নিয়ন্ত্রন আইন অনুসারে ৫৪ দশমিক দুই শতাংশ গণপরিবহনে ধূমপান বিরোধী সর্তকীকরণ চিহ্ন ব্যবহার হচ্ছে না। ধূমপান বিরোধী সর্তকীকরণ চিহ্ন শপিংমলগুলোতে ব্যবহার হচ্ছে ১৬ শতাংশ, শিশু পার্কগুলোতে ৩ শতাংশ, সিনেমাহলে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিকে হচ্ছে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮ দশমিক এক শতাংশ এবং ট্রেন স্টেশন ২ দশমিক ৮ শতাংশ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে সর্তকীকরণ চিহ্ন ব্যবহার হচ্ছে। তবে চারটি জেলার বাস টার্মিনালগুলোতে কোথাও কোন সর্তকীকরণ চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
জরিপে দেখা গেছে ২৪ শতাংশ মানুষ ছোট গণপরিবহনে ধূমপান করছে। এ ছাড়া আদালত এলাকায় ৪ শতাংশ, বিপনীবিতানগুলোতে ১২ শতাংশ, শিশু পার্কগুলোতে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ, সিনেমা হলে ৮ শতাংশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৮ শতাংশ, হসপিটাল এবং ক্লিনিকে ৪ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গুলোতে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে।
তারা বলছে, এই পরিস্থিতিতে তামাক নিয়ন্ত্রন কার্যক্রমকে জোরদার করার জন্য টাস্কফোর্স কমিটি ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে আরো সক্রিয় করার মধ্যদিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রনে সরকার, এনজিও ও অনান্য প্রতিষ্ঠানকে আরো যথাযথ ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। সংস্থাটির মতে, ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের পূর্ণবাস্তবায়ন জরুরি। এ ক্ষেত্রে আশার কথা দেশের বেশিরভাগ মানুষ তামাকের কুফল সম্পর্কে অবহিত। এমতাবস্থায় ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হবে। তার জন্য আইন ভঙ্গকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।