বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার জাতিকে আরও সম্মৃদ্ধ করবে

0
1119

দীপক রায়
মনের ভাব প্রকাশের সবথেকে উত্তম মাধ্যম হল ভাষা। শুধু মানুষ ভাষা ব্যবহার করে না, পৃথিবীর যত পশুপাখি সকলের নিজস্ব ভাষা রয়েছে এবং প্রত্যেকেই তাদের জাত, ধর্ম এবং গোত্রের মধ্যে নিজস্ব ভাষাতে কথা বলে। স্থান কালপাত্র ভেদে ভাষা বিভিন্ন রকমের হয়। সহজ ভাষায় শিশু জন্মের পর থেকে মায়ের মুখে যে ভাষা শুনতে শুনতে বড় হয় সেটিই হল মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষা পরস্পর ব্যবহারের মাধ্যমে গোটা দেশের মানুষের ব্যবহৃত ভাষা তাদের মাতৃ ভাষায় রূপ নেয়।

ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মাতৃভাষা রয়েছে। ইতিমধ্যে অবশ্য অনেক ভাষার ব্যবহার হারিয়ে গিয়ে ভাষার মৃত্যু ঘটেছে। বাংলা জন্মগতভাবেই বাঙ্গালীদের মাতৃভাষা। ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্থান আমল পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে মুছে ফেলার জন্য ছিল বিভিন্ন ষড়যন্ত্র। এর মূল কারন ছিল বৃটিশ তাড়ানো আন্দোলনে বাঙ্গালীদের অগ্রনী ভূমিকা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে ভাগ হয়ে যখন পাকিস্থানের জন্ম হল তখনও পশ্চিম পাকিস্থানীরা বাংলাকে উর্দুর প্রতিপক্ষ ভাষা হিসাবে দেখতে শুরু করে। নানা বৈশম্যের শিকার পূর্ববাংলাকে পাকিস্থানের পদানোত রাখার জন্য এবং বাংলার সকল উন্নয়নকে স্তব্ধ করার জন্য প্রথম আঘাতহানে বাংলা ভাষার উপর। উর্দুকে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষনার পর থেকে শুরু হয় বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন। আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী আন্দোলনরত জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন রফিক, সালাম, জব্বার , বরকত, শফিকসহ আরও অনেকে।

আমাদের দূর্ভাগ্য আজও ভাষাশহীদদের সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। সৃষ্টি হয় মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহান ইতিহাস। সেদিন থেকে বাঙ্গালী ২১ ফেব্রুয়ারীকে ভাষা শহীদদের স্মরনে শহীদ দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। পরবর্তিতে এই আন্দোলনের হাত ধরে বাঙ্গালী পেয়েছে স্বাধীনতার প্রেরণা, পেয়েছে স্বাধীন পতাকা, মানচিত্র এবং মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা(ইউনেস্কো)-এর সাধারন সম্মেলনে ইউনেস্কো সাধারণ পরিষদের ১৮৮ সদস্যের সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তে ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করা হয়। এখন ২১ শে ফেব্রুয়ারী শুধু বাঙ্গালীর মাতৃভাষা দিবস নয় সারাবিশ্বের। এই মহান অর্জনের জন্য ইউনেস্কোর সাথে প্রধান যোগাযোগকারী কানাডা প্রবাসি মো. রফিকুল ইসলাম, মো. আব্দুস সালাম, মাতৃভাষা প্রেমিক গ্রুপ এবং প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। বারবার ব্যর্থ হয়েও তাঁরা আশা ছেড়ে দেননি জাতি কোনোদিন তাঁদের কথা ভূলবে না। ভাষাদিবসে বাঙ্গালীরা ভাষা সৈনিকদের সাথে এই মহান ব্যক্তিদের চিরদিন মনে রাখবে।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাই-

মাতৃভাষা রক্ষার ইতিহাস প্রায় সবাই কমবেশি জানে। যে ভাষা রক্ষার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে, যে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় রূপ দিতে কি ত্যাগ, শ্রম এবং সময় ব্যয় হয়েছে সেটা বলা বাহুল্য। কিন্তু কথা হচ্ছে এতকিছুর বিনিময়ে আমরা যে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছি সেই ভাষার চর্চা ও ব্যবহার কি আমরা ঠিকমত করতে পারছি? প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারী এলে দিবসটি নিয়ে নানা আয়োজন, নানা বক্তব্য হয় এরপর সারাবছর এ নিয়ে আর কোনো কথা হয় না। দিবসটি এলেই শুনি বাংলা ভাষায় ডাক্তারী বই ছাপাতে হবে, আইনের বই লিখতে হবে, এর উচ্চারণ ও ব্যবহার বাংলার মত করে করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলি থেকে যায় শুধু খাতা কলমে এর বাস্তবতা এখনও দেখা যায়নি।

আজ মনে পড়ে গেল, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য যে বই প্রকাশিত হয়েছে তার অধিকাংশই ভূলে ভরা আজও সম্পূর্নরূপে ত্রুটিমুক্ত হয়নি। এ নিয়ে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত হৈচৈ হয়েছে। কেউ এর দায় স্বীকার করতে চায় না। গোটা জাতির কাছে বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট, বিদ্যালয়ের বইগুলি কারা নির্ভূলভাবে প্রকাশ করবেন-এর দায়-দায়িত্ব কাদের! ক্লাশে শুধু গাদাগাদা বই তা আবার ভূলে ভরা। এভাবে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করার দরকার কি? এখন প্রশ্ন আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কি সঠিক বাংলা ভাষার পুস্তক রেখে যেতে পারছি না! বর্তমান বানান রিতি নিয়ে নানা সমস্যা। পন্ডিত ব্যক্তিদের বলতে শুনি বাংলার শুদ্ধ বানান কি বাংলাদেশ থেকে উঠে যাবে এমনই আশঙ্কা করতে শুনি অনেকেরই! বানানের কারনে শব্দের অর্থ পাল্টে যায় সেদিকটা বিবেচনায় আনা খুবই দরকার।

আগেকার দিনে স্বল্প শিক্ষিত একজন পাঠশালার পন্ডিতের যে শুদ্ধ বানান করার ক্ষমতা ছিল এখন অনেক নামধারী শিক্ষিত মানুষের মধে অনেক সময় তা দেখা যায় না। উচ্চারণের কথা আর কি বলবো আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত ঘরের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে মেয়েরা তো বাংলা বলতেই ভূলে গিয়েছে। ঢাকার কোনো কোনো স্কুলে অভিভাবকদেরও ইন্টারভিউ করা হয় যে তারা বাড়ীতে ছেলে মেয়েদের সাথে ইংলিশ টকিং করতে পারবেন কিনা। বিত্তশালীদের ধারণা, ভাল ইংরেজী না জানলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাহলে বাংলা কি নি¤œবিত্ত ও গরীবদের শিক্ষা! এমনি নানা প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আমরা ছোটবেলায় ২১শে ফ্রেব্রুয়ারীতে খালি পায়ে প্রভাত ফেরিতে বের হতাম। মাটি ও ইটের বানানো শহীদ মিনারের পাদদেশে শহীদদের স্মরণে পুষ্প নিবেদন করতাম। দেশ স্বাধীনের ৪৮ বছর পরেও দেখি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি শহীদ মিনার নেই। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত দঃখের এবং লজ্জার। আমাদের ভাষা চর্চা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস সংরক্ষনের জন্য যদি রাষ্ট্রিয়ভাবে উদ্যোগ না নেওয়া হয় তাহলে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কি হবে বলা কঠিন।

বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হলে এর সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষন ও শিক্ষণের দরকার। এজন্য রাষ্ঠ্রিয়ভাবেই বোর্ড গঠন করে প্রকৃত ভাষা বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব দিতে হবে। গোটা জাতি যেন অন্তর থেকেই এর ব্যবহার এবং রক্ষার জন্য কাজ করে আজকের দিনে এ কথা ঠিক করতে হবে। শহীদ দিবস আমাদের শোক, শ্রদ্ধা অর্জন ও অহংকারের এ কথা বাঙ্গালীদের ভুলে গেলে চলবে না। এ ভাষার সঠিক ব্যবহার যদি আমরা করতে পারি তাহলে সেটিই হবে ভাষাশহীদদের প্রতি আমাদের যোগ্য সম্মান দেখানো।

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও যুগান্তরের সংবাদকর্মী