বহিঃবিশ্বে নন্দিত খুলনার সাংবাদিক মানিক সাহা

0
580

কাজী মোতাহার রহমান
সকালে অথবা সন্ধ্যায় বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে ইথারে-ইথারে পৌঁছে যেত খুলনার সংবাদকর্মী মানিক চন্দ্র সাহার কণ্ঠ। বিবিসি’র মাধ্যমে বিশ্ববাসির কাছে তিনি খুলনাকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ অঞ্চলের মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশ নষ্ট, নোনা পানিতে শত শত বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ, সুন্দরবনে সুন্দরী গাছে আগামরা রোগ, মংলা বন্দরকে গতিশীল করা, এরশাদ শিকদারের বিচার দ্রুত সম্পন্ন এবং অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে তিনি একাধিক প্রতিবেদন প্রচার করেছেন বিবিসি’র মাধ্যমে। ভারতের অযোদ্ধ্যায় বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে খুলনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রস্তুতি শুরু হলে স্থানীয় রাজনীতিকদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছিলেন। সৃজনশীল সংবাদকর্মী হিসেবে একাধিকবার নন্দিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের চিত্র, পাইকগাছায় করুণাময়ী সরদারের মৃত্যুর পর অবৈধ চিংড়ি ঘের বন্ধে গণআন্দোলন, ঠাকুরবাড়ীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে অত্যাচার সর্বোপরি বাগেরহাটের রামপালের ছবি রানীর ওপর নির্যাতনের চিত্র নিয়ে লেখা প্রতিবেদন বিবিসি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সাড়া জাগায়। আর এ প্রতিবেদন তৈরীর কারিগর ছিলেন খুলনার গর্বিত সাংবাদিক মানিক চন্দ্র সাহা।
তিনি খুলনার ছাত্র ও কমিউনিষ্ট আন্দোলনের চেনা মুখ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কারাবরণও করেছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে লিফলেট বিলি করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে বেশকিছু দিন কারান্তরীণ ছিলেন। জেঃ এরশাদ বিরোধী খুলনার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে দাড়িয়ে প্রতিবাদমুখর হয়েছিলেন; তখনও তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। ছাত্রজীবন শেষে রূপসা ও খালিশপুরের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। একপর্যায়ে সাংবাদিকদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। শ্রমিকদের বকেয়া পাওয়া, লেঅফ মিল চালু, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, নানা সময়ের কালাকানুন বাতিল এবং ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নে গণমাধ্যমকর্মীদের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মার্কসবাদী দর্শনে বিশ^াসী। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অবসানে শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর কমিউনিষ্ট আন্দোলনে ভাটা পড়লেও তিনি লাল পতাকা ছেড়ে দুরে থাকেননি। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের যখন জয় জয়কর অবস্থা ভারত সফরে গেলে সিপিআইয়ের পক্ষে কথা বলতেন। শোষণের বিরুদ্ধে লাল পাতাকাকে আকড়ে ধরে আমৃত্যু লড়াই করেছেন। তার রণনীতি ও রণকৌশলের সাথে কখনও একমত হতে পারেনি। বিপরীতমুখী চিন্তা চেনতায় উদ্বুদ্ধ হয়েও অনেক সময় আমরা তাদেরকে সমালোচনা করেছি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় লড়াই সংগ্রামে তিনি শ্রমিক শ্রেণির মানুষকে সংগঠিত করেছেন। তার ত্যাগ শ্রম ও মেধা কমিউনিষ্টরা শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। তিনি গণমানুষের মুক্তির মিছিলে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের মুক্তির জন্য সংগ্রামী কাফেলায় তার উপস্থিতি অন্যদের অনুপ্রাণিত করেছে। ভিন্নতর ও বিপরীতমুখী রাজনৈতিক অবস্থানের মানুষ হলেও কখনও তার সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৈরীতার সৃষ্টি হয়নি। তার মৃত্যুর পর ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট যে বিবৃতি প্রচার করে তারমধ্যে একটি বাক্য, “গধহরশ রং ঃযব ঋরৎংঃ ঔড়ঁৎহধষরংঃ ঃড় নব করষষবফ রহ ২০০৪.” খুলনার সৃজনশীল এই সংবাদকর্মী স্বশরীরে আমাদের মাঝে নেই। সৃষ্টির মধ্যে তিনি বেঁচে আছেন। ১৯৯৩ সালের ২৩ জুলাই কমিউনিষ্ট নেতা রতন সেনের স্মৃতি রক্ষার্থে রতনসেন পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপনে গঠিত কমিটির তিনি ছিলেন আহ্বায়ক। তার মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার কর্মী ক্রোরালি থর্নটন শোকবার্তা উল্লেখ করেন, “মানিক সাহা হত্যাকান্ড আমাদের যারপরনাই ব্যাথিত করেছে। আমাদের বাংলাদেশ সফরকালে তার সহযোগিতা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তার সেই আন্তরিকতা ভুলবার নয়। ইউকুয়েডের মুখপাত্র লাইডার গঙ্গোরা বিবৃতিতে বলেন, “মানিক সাহার হত্যাকান্ড দুঃখজনক। এ ঘটনা দিয়ে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের মানুষেরা কি রকম দুরাবস্থার মধ্যে রয়েছে। সিএপি এবং এসএএম মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি শোকবার্তায় বলেন, “মালিক সাহা ছিলেন সাহসী ও বিচক্ষণ। তার এইধরণের হত্যাকান্ড অমানবিক। যুক্তরাজ্যে নিকোলাস রাজ্যের হিল্ডইয়ার্ড শোকবার্তায় বলেন, “সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্যে তার দৃঢ় সংগ্রাম ও আত্মহত্যা অনুকরণীয়। সারাদুনিয়া জুড়ে হাজারো মানুষ রয়েছে যারা মানিকের এই অনমনীয় দৃঢ়তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাবে। (সূত্র: সাংবাদিক মানিক সাহা স্মারকগ্রন্থ)”। প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের অদুরে ছোট মির্জাপুরের রাস্তায় বোমা হামলায় নিহত হন মানিক চন্দ্র সাহা।