প্রাপ্য খাবার থেকে বঞ্চিত খুলনা সদর হাসপাতালের রোগীরা

0
1570

কামরুল হোসেন মনিঃ
লিপি আক্তারের মা রাশিদা বেগম। গত বৃহস্পতিবার তার মেয়েকে গাইনী বিভাগে ভর্তি করেন। রূপসা উপজেলার শিরগাতী এলাকার বাসিন্দা। মেয়ে গর্ভবতী। ভাত নিতে তিনি লাইনে দাঁড়ান। এখানে সরবরাহকৃত ভাতের বিষয়ে বলেন, ভাতে গন্ধ থাকলে বা কি না থাকলে বা কি, আর মরা ভাত থাকলেও করার কিছু থাকে না। বাঁচার তাগিদে খাওয়া লাগে। তার মতো অনেকে রোগীরই আত্মীয় স্বজন একই অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, ডাল, মাছ ও তরকারিতে মসল্লা নেই বললেই চলে। তরকারির ওপর কাঁচা তেল ভাসে। আমরা অসহায় রোগী আমরা বাঁচার তাগিদে সবকিছুই খাই। খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের খাবার সরবরাহের চিত্র। যেমন রান্নার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তেমনি সবকিছু খাবারে ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে। অসহায় রোগীরা তাদের প্রাপ্য খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

খুলনা সিভিল সার্জন ডাঃ এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, হাসপাতালে রোগীদের খাবার সরবরাহে অনিয়ম হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, এই বিষয়টি আরএমও সাহেব দেখভাল করেন।


হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, রান্না করার পর যখন আমার এখানে নিয়ে আসেন তখন ভাল খাবার সামনে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, হাসপাতালের খাবার রোগীদের জন্য, আমার এখানে ভাল দেখিয়েতো লাভ নেই। রোগীরা ভাল সেবা ও ভাল মানের খাবার পাবেন এটাই আমরা চাই। তিনি বলেন, এই বিষয়ে সদ্য যোগদানকারী ওয়ার্ড মাস্টারকে খোঁজখবর নিতে বলেছি। অনিয়ম পাওয়া গেলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা জেনারেল হাসপাতালের কুকমশলাচি মোঃ বাবু বলেন, বাজারে যদি কোন সমস্যা থাকে তাহলে মাংসের বদলে মাছ বা ডিম দেওয়া হচ্ছে। মোটা চালের ভাতের বিষয় বলেন, ভাতে কোন ঝিল নেই, তবে মরা চাল রয়েছে। তিনি বলেন, অফিস থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেন আমি সেভাবে রান্না করি।
জানা গেছে, হাসপাতালে আগত ভর্তি রোগীদের খাবারের জন্য সরকারিভাবে মাথা পিছু বরাদ্দ ১২৫ টাকা। এর মধ্যে ১নং পথ্য, ২নং পথ্য, ডায়াবেটিক পথ্য ও স্পেশাল পথ্য রয়েছে। ওই টাকার মধ্যেই রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ১নং পথ্য তালিকায় রোগীরা প্রতিদিন খাবার হিসেবে পাউরুটি ১৩৩ গ্রাম (৪ পিস), ডিম ১টি, কলা ২টি, চাল ৪শ’ গ্রাম, আলু ৫০ গ্রাম, তরকারি ২শ’ গ্রাম, ডাল ২৫ গ্রাম উল্লেখ রয়েছে। রুই অথবা কাতলা রান্নায় প্রতি রোগীরা পাবেন ১১০ গ্রাম পরিমাণ। আর যদি পাঙ্গাস মাছ দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে রোগীরা পাবেন ১৭০ গ্রাম, যদি খাসির মাংস দেওয়া হয় তাহলে পাবেন ৭৮ গ্রাম, মুরগি (ব্রয়লার) দিলে পাবেন ১৪৪ গ্রাম আর যদি ইলিশ মাছ দেওয়া হয় তাহলে প্রতি রোগীরা ৩৫ গ্রাম ওজনের রান্নাকৃত মাছ পাবেন। এর মধ্যে সপ্তাহে ২ দিন উল্লিখিত যে কোন মাংস রোগীদের সরবরাহের কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক সময় রোগীরা সপ্তাহেও মাংস পান না। তার বদলে ডিম বা মাছ সরবরাহ করা হয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালে রোগীদের খাবার বিতরণের সময় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা দুপুরে খাবারের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। একে একে এসে রোগীর আত্মীয় স্বজনরা খাবার নিচ্ছেন। খাবার বিতরণের সময় দেখা গেছে সব খাবারের পরিমাণ যেমন কম, তেমনি খাবারের মান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। ডালের পাত্রে দেখা যায় শুধুই পানি। মাছের ওজনও ৫০-৬০ গ্রামের বেশি হবে না। ভাতের পরিমাণও কম। চালটাও নি¤œমানের। মোটা চালের রান্না ভাতে দেখা গেছে, মরা চালে ভর্তি রয়েছে। তরকারির পরিমাণও কম। যা অসহায় রোগীরা তাদের প্রাপ্য খাবারের থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি খাবারের রান্নাও নি¤œমানের। রোগীদের মাছের লেজ ও মাথা সরবরাহ নিষেধ থাকলেও তাও মানা হয় না। ৩য় তলায় ফ্রি সার্ভিস সোহাগ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের খাবার দেওয়ার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। তার সাথে রয়েছেন অপর ফ্রি সার্ভিস এক মহিলা তাহমিনা। খাবারের ছবি তুলতে গেলে প্রথমে বাধা দেন। ভাতের মধ্যে মরা চাল ভরা বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, মূল বাবুর্চি রয়েছে মোঃ বাবু। তাকে জিজ্ঞাসা করেন। আমি তার সহযোগী। ৯ মাস ধরে ফ্রি সার্ভিস হিসেবে এখানে কাজে যোগ দিছি।
রোগীরা জানান, ৪ পিস পাউরুটি সকালে দিলেও তা পাতলা, ওই রুটির ওজন ৭০ গ্রাম হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। দুপুর ও রাতের খাবারের মান ভাল না থাকায় যারা একটু মধ্যবিত্ত রয়েছেন তারা বাইরে থেকে কিনে এনে খাচ্ছেন।
হাসপাতালের বাবুর্চি মোঃ বাবু জানান, ১৪১ ভর্তি রোগীর মধ্যে ১২৩ জনের খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। বাকীটার বিষয়ে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে বলেন, অফিস যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে সেভাবে পালন করছি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যারা খাবার সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের পকেটেই চলে যায় সিংহভাগ অংশ। আর এটি করা হয় প্রতি বছরের এ সংক্রান্ত টেন্ডারকালে। নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে সরবরাহকৃত চালের মূল্য ধরা হয় প্রায় ৫০ টাকা। প্রতি বছর বাজার দর হিসেবে এই চালের মূল্যও বৃদ্ধি হতে থাকে। একইভাবে উন্নতমানের চিকন চালের কথা নথিপত্রে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার দেখা মিলছে না এ হাসপাতালে। একই হাসপাতালে দীর্ঘ বছর একই ঠিকাদার থাকার কারণে এই অনিয়ম দিনকে দিন বেড়েই চলে বলে অনেকের অভিমত।
সূত্র মতে, ২০১৩ সালে এপ্রিলের দিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে খাবারের মান বাড়াতে শয্যা প্রতি দৈনিক বরাদ্দ ৫০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। ওই সময় থেকেই সরকারি হাসপাতালে খাবার বাবদ প্রত্যেক রোগীর জন্য দৈনিক বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৫ টাকা। এর আগে সরকার ২০০৯ সালে রোগীদের খাবারের বরাদ্দ ৫৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করেন। কিন্তু বরাদ্দ বাড়লেও বাড়েনি রোগীর খাবারের মান ও সঠিক ওজনে খাবার সরবরাহ। সরকারি হাসপাতালে অসহায় রোগীরা তাদের প্রাপ্য খাবারের থেকে বরাবরই বঞ্চিত হয়ে আসছেন।