প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে “One day one word” কার্যক্রম বাস্তবায়নে কৌশলপত্র

0
516

মোহাম্মদ হেলাল হোসেন
বিএ (অনার্স), এমএ (ঢাবি)
পিজিডি (যুক্তরাজ্য), এমবিএ (যুক্তরাজ্য)
ডক্টর অব বিজনেজ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ((রিসার্সার)
বিসিএস (প্রশাসন)

“We’ve set our goal to make the country prosperous. To make that happen, I always think it’s only education that can lead the country towards prosperity.”

–Hon’ble Prime Minister Sheikh Hasina.”

প্রকৃতই একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রধান বাহন হচ্ছে শিক্ষা। আর সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সর্বাধিক কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। কেননা শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও প্রাথমিক স্তরে শিশুরা যে মানের শিক্ষা লাভ করে, পরিণত বয়সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারই প্রতিফলন ঘটে। একটি শিশু ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায়নীতিবান, আদর্শবান, চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তাঁর প্রাথমিক জীবনের শিক্ষার উপর।
বিগত এক দশকে বাংলাদেশ মানব উন্নয়নে, বিশেষ করে শিক্ষাখাতে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে। আওয়ামীলীগ সরকারের পরপর দুই মেয়াদে এখাতে গঠনমূলক বেশ কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এসময়স কাল স্তরে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি থেকে শুরু করে জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করা হয়েছে।
‘One day one word’ কার্যক্রমের প্রেক্ষাপট
একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাথমিকস্তরে ছেলে-মেয়ে ভর্তির হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত একদশকে এই স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মান ও ফলাফলের দিকেও গুরত্ব দেয়া হয়েছে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রতিনিয়ত পাঠ্যক্রম, সিলেবাস ও পুস্তকের বিষয়বস্তু উন্নত করা, শিক্ষকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ জোরালো করাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল উদ্ভাবনী ধারণার মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু করেছে ‘One day one word’ কার্যক্রম যা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মান্যবর সচিব জনাব মোঃ আকরাম-আল-হোসেন এর ব্রেইন চাইল্ড। ‘One day one word’ কার্যক্রম হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দৈনিক একটি করে বাংলা ও একটি করে ইংরেজি শব্দ সঠিক উচ্চারণে পড়া, বলা ও লেখা শেখানো- সেই হিসাবে সর্বমোট দৈনিক দুটি করে শব্দ শেখানো।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং দক্ষ জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পরিচর্যার প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ে বিদ্যালয় পরিদর্শনে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে পঠন-লিখনে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে এবং শিক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজি শব্দ ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে ‘One day one word’ কার্যক্রমের বিকল্প নেই। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এই কার্যক্রম ঢাকার একটি বিদ্যালয়ে (ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। এরপর ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে সকল জেলায় এ কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশনা জারি করা হয়, যার মাধ্যমে প্রায় ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই উদ্ভাবনী কার্যক্রম যাত্রা শুরু করে। তবে শুধু কার্যক্রমের উদ্বোধন বা সূচনাই যথেষ্ট নয়, বরং স্কুল ভিত্তিক যথাযথ কৌশলপত্র প্রণয়ন ও ধারাবাহিকতার সাথে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল দীর্ঘ মেয়াদে এ কার্যক্রম এর সুদূর প্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হতে পারে।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
‘One day one word’ কর্মসূচিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী স্কুলে তার ইংরেজি ও বাংলা পাঠ্য বইয়ের পাঠ্যসূচি থেকেই প্রতিদিন একটি করে শব্দ শুদ্ধভাবে পড়তে শিখবে, বানানসহ মুখস্ত করবে এবং লিখতে শিখবে। এতে করে ছাত্রছাত্রীর শব্দ ভান্ডার সমৃদ্ধ হবে; একই সাথে শিশুরা শব্দের মর্মার্থ অনুধাবনে সামর্থ্য অর্জন করে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবে। তারা এই শব্দসমূহ দৈনন্দিন জীবনে কথোপকথনে ব্যবহার করে সাবলিলভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারবে এবং তাদের লেখার ক্ষেত্রে এসব শব্দের ব্যবহার তাদের লেখনীকেও মানসম্মত লেখনীতে রুপান্তরিত করবে। ওয়ান ডে ওয়ান ওয়ার্ড কার্যক্রমের মাধ্যমে একজন শিশু ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বাংলা ও ইংরেজী দুই বিষয়ে কমপক্ষে দুই হাজার শব্দ শুদ্ধভাবে পড়তে, বলতে ও লিখতে শিখবে। পরবর্তীতে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে শিক্ষাক্রমের বিষয়ব¯ বুঝতে সহজ হবে।
‘One day one word’ বাস্তবায়ন কৌশলঃ
প্রাথমিক স্কুলের শিশুরা মূলত চারটি ধাপে শিখে থাকেঃ
১। Visual learning (দেখেশেখা)-বই পড়ে বা ছবি দেখে কোনো কিছু শেখা
২। Auditory learning (শুনেশেখা)-অনেক সময় কোন একটা বিষয় অনেকবার পড়ার পরেও মনে রাখা সহজ হয় না, কিন্তু কেউ তা পড়ে শুনালে অধিক কার্যকর হয়
৩। Verbal বা Communicative learning (বলেশেখা)-নিজে কোন বিষয় ভালভাবে বুঝে অন্যকে বোঝালে বিষয়টি ভালোভাবে
৪। Kinesthetic learning (খেলারছলেশেখা) -চেয়ারে বসে না থেকে খেলার ছলে শেখলে শিশুদের মনোযোগ বাড়ে এবং তা বেশিদিন মনে থাকে।
যখন কোন শিশু নতুন একটি শব্দ শেখে তখন একই সাথে পাঁচটি বিষয়ে তারজ্ঞান আহরণ হয়ঃ
* শব্দেরঅর্থ (meaning)
* শব্দেরবানান (spelling)
* শব্দেরউচ্চারণ (pronunciation)
* শব্দেরব্যবহার (usage)
* শব্দ মুখস্থকরণ বা মনে রাখার কৌশল (memorization)
তাই একটি শব্দ শেখা মানে শুধু একটি শব্দ শেখা নয় বরং এর সাথে আরো পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা এবং একটি অর্থগত বাক্যে শব্দটি ব্যবহার করতে পারা।

‘One day one word’ কার্যক্রমকে দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর রাখতে সুপারিশসমূহঃ
* প্রতিটি বিদ্যালয়ে ক্লাসভিত্তিক একটি ডিজিটাল রেজিস্টার মেইন্টেইন করা, যেন বাচ্চারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ শিখতে পারে এবং পরবর্তী ক্লাসেও পুরানো শব্দের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এভাবে বাচ্চাদের শব্দ ভান্ডার নতুন নতুন শব্দ দ্বারা সমৃদ্ধ হবে।
* বছরের প্রথম দিনে নববর্ষের উপহার হিসেবে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বাংলা এবং ইংরেজীর পকেট অভিধান বিতরণ করা এব কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তা শিখিয়ে দেয়া যেতে পারে।
* পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে ক্লাসে শেখানো শব্দগুলো মনে থাকছে কিনা তা মূল্যায়ন করা। যারা মনে রাখতে পারছে তাদের একটি স্মাইল কার্ড দেয়া যেতে পারে। আর যারা ব্যর্থ হচ্ছে তাদেরকে বিশেষ যত্ন সহকারে নতুন করে সে সব শব্দ শেখানো।
* যেসব শব্দ শেখানো হচ্ছে তা ক্লাসে ও বাহিরে আকর্ষণীয় করে ঝুলিয়ে রাখা যেতে পারে। এতে কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে পরদিন সে এসে নতুন শব্দ শিখতে পারবে। এছাড়াও শ্রেণি কক্ষের দেয়ালে, বোর্ডে বা সিঁড়িতেও এসব শব্দের প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে রাখা যেতে পারে।
* প্রতিটি ক্লাসের শ্রেণী শিক্ষক প্রতিটি শ্রেণীর জন্য আলাদা আলাদা রেজিস্টার ব্যবহার করবেন। ফলে বছর শেষে শিক্ষার্থী কতটি শব্দ শিখল তা জানা সহজ হবে। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন খেলা ও কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে বছর শেষে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
* প্রাথমিক শিক্ষায় মানসম্মত ভাষার শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করতে হবে এবং শিক্ষকরা যেন যথাযথভাবে বাচ্চাদের শিখাতে পারে সেজন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
* শব্দ শিক্ষণের কাজে শিক্ষকগণ ব্যবহার বিভিন্ন বাস্তব উপকরণ, অর্ধবাস্তব উপকরণ (ছবি, মডেল), ভিডিও, অডিও ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। আবার কখনও অভিনয়, মুকাভিনয়, বিপরীত শব্দ, সংজ্ঞা, উদাহরণ, অনুবাদ, শব্দ কার্ড বিতরণের মাধ্যমে বাচ্চাদের কাছে এ কার্যক্রমকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন। আয়োজন করতে পারেন শব্দ ভিত্তিক বিভিন্ন ছোট ছোট খেলা যার মধ্যে রয়েছে- Bingo game, Preposition game, Hunt the pencil game, Mime game, Guessing game, Kims game, Spotting mistakes, Family game, Word square ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় উদ্ভাবনী উদ্যোগ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। আর এসব উদ্যোগের মধ্যে ‘One day one word’ কার্যক্রম অন্যতম ফলপ্রসূ উদ্যোগ হতে পারে, কেননা এর মাধ্যমেই দীর্ঘ মেয়াদে শিশুরা তাদের শব্দ ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে এবং পঠন ও লিখন দক্ষতা উন্নয়নে সক্ষম হবে। আর এই শিশুরাই হবে আগামী দিনের উন্নত, সমৃদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সত্যিকারের রূপকার।