প্রণোদনা সত্ত্বেও হুন্ডির কারণে দেশে আসছে না প্রবাসীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা

0
361

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না হুন্ডি। অথচ হুন্ডি বন্ধ হলে দেশে রেমিট্যান্স বাড়বে দ্বিগুণ। মূলত হুন্ডির কারণেই প্রবাসীরা দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠালেও সরকার লাভবান হতে পারছে না। বরং প্রবাসীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। ফলে প্রণোদনা দিয়েও সরকারের তেমন লাভ হচ্ছে না। বরং সাময়িক সুবিধার কারণে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে ব্যাংক এড়িয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো থেকে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাঠানোয় আগ্রহ নেই। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, হুন্ডি বন্ধ হলে রেমিট্যান্স আসবে দ্বিগুণ। অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো টাকা তৎক্ষণাৎ প্রবাসীদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়। টাকা পাঠাতে চার্জ লাগে না। তাছাড়া মুদ্রার বিনিময়মূল্যও বেশি। আর ব্যাংকে চার্জ দিতে হয়। টাকা পেতে লাইন দিতে হয়। টাকা নিয়ে ফিরতে নিরাপত্তাঝুঁকি আছে। তাছাড়া মুদ্রার বিনিময়মূল্যও কম। আবার ব্যাংকে টাকা পাঠালে পরে আয়করের ঝামেলা হতে পারে বলে অনেকে ভয় পান। এসব সমস্যার কারণেই প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসীদের ভয় ও ভোগান্তি দূর করা জরুরি।
সূত্র জানায়, বৈদেশিক শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি পাঠানোয় বাংলাদেশ অন্য দেশ থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তাছাড়া উন্নত বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া এবং বিদেশে গিয়ে ভিসা-সংক্রান্ত নানা জটিলতায় পড়ে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বাজারমূল্যের চেয়ে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শ্রমিকদের গড় রেমিট্যান্স বাড়েনি। প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী ১৯৭৬ সালে বিদেশে ৬ হাজার ৮৭ জন কর্মী পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রবাসযাত্রা। ওই বছর রেমিট্যান্স এসেছিল ২ কোটি ৩৭ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার। গড় হিসাব করলে জনপ্রতি রেমিট্যান্স এসেছিল ৩ হাজার ৮৯৫ মার্কিন ডলার। ২০১৮ সালে প্রবাসীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি। রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। জনপ্রতি ১ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলার। মোট রেমিট্যান্স বাড়লেও বছরে জনপ্রতি পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা কমেছে ২ হাজার ৩৪১ ডলার। শ্রমশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বলছে, চলতি বছর শেষে এ হার আরো কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অথচ চার দশকে সারা বিশ্বে শ্রমমজুরি কয়েক গুণ বাড়ায় রেমিট্যান্সও সে হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল।
সূত্র আরো জানায়, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে গেছেন প্রায় ১ কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার বাংলাদেশি। চার দশকে প্রবাসীর সংখ্যা ১৬০০ গুণ বাড়লেও রেমিট্যান্স বেড়েছে মাত্র ৬৫৫ গুণ। অর্থাৎ আগে যে অর্থ দুজনে পাঠাতেন, এখন পাঠান পাঁচজনে। এমনকি ১৯৮৪, ’৮৫, ’৮৯, ’৯০, ২০১৩, ’১৬ ও ’১৭ সালÑ প্রতি বছর বিদেশে ৫৬ হাজার থেকে ১০ লাখ নতুন জনশক্তি যোগ হলেও বিগত বছরের তুলনায় মোট রেমিট্যান্স না বেড়ে উল্টো কমেছে। ২০১৬ সালে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার। ২০১৭ সালে নতুন করে বিদেশ যান ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন। কিন্তু রেমিট্যান্স না বেড়ে আগের বছরের চেয়ে ৮ কোটি ডলার কমে যায়। অথচ এশিয়ার অনেক দেশ এর চেয়ে কম জনশক্তি পাঠিয়েও কয়েক গুণ বেশি রেমিট্যান্স আয় করছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ লাখের বেশি প্রবাসী শ্রমিকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মতো। একই সময়ে এশিয়ার দেশ ফিলিপাইন ৬৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের মাধ্যমে পেয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ একজন ফিলিপাইনি নাগরিক যেখানে পাঠিয়েছেন ৫ হাজার ৭৬ ডলার, সেখানে একজন বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধা পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৫৫৫ ডলার।
এদিকে এ বিষয়ে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জানান, বিদেশ যাওয়া শ্রমিকের ৫০ ভাগই অদক্ষ। যাদের দক্ষ বলে পাঠানো হচ্ছে তারাও চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ নন। চাহিদা এক দক্ষতার কিন্তু আছে অন্য দক্ষতা। মাঝারি দক্ষ ও কম দক্ষ বলে যাদের পাঠানো হচ্ছে তারা মূলত অদক্ষ। দক্ষ ক্যাটাগরিতে অদক্ষ যাচ্ছেন অনেক। তারা কম মজুরিতে কাজ করছেন। অনেকে কাজ হারাচ্ছেন। এতে একদিকে শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে মাথাপিছু রেমিট্যান্স কমছে। বিদেশে দক্ষতার স্বীকৃতি অন্যতম একটা ব্যাপার। যে দক্ষতার প্রয়োজন নেই, তা শিখিয়ে পাঠালে লাভ হবে না। এছাড়া বিদেশ থেকে অর্ধেক টাকাই আসছে হুন্ডি-হাওলার মাধ্যমে। এতে বৈদেশিক মুদ্রাও বিদেশে থেকে যাচ্ছে। হুন্ডি বন্ধ করলে রেমিট্যান্স দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তবে তা জোর করে নয়, ব্যাংকের সুবিধা বাড়িয়ে করতে হবে।