প্রকৃতির প্রাণ পাখি রক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে

0
422

বাংলাদেশ পাখপাখালির দেশ। নানা রঙের নানা আকারের মিষ্টি সুরের পাখি আমাদের। শহরায়ন প্রক্রিয়ার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাখির উপস্থিতি কমছে দ্রুত গতিতে। অথচ জীববৈচিত্র্য প্রক্রিয়ায় পাখি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বীজের বিস্তরণ প্রক্রিয়ায় পাখি উদ্ভিদ বিস্তারেও অপরিহার্য। বাস্তব সত্য হলো পাখির পরিমাণ ক্রমেই কমে যাচ্ছে আমাদের দেশ থেকে। এর জন্য দায়ীও আমরা। আমাদের নগরায়ণ প্রক্রিয়ার ফলে পাখি তার আবাসস্থল হারিয়ে ফেলছে। অনেক পাখির অস্তিত্ত্বই আজ সংকটে। হয়তো এসব পাখি আর বাংলায় ডানা মেলে উড়বে না কোনোদিন। উদাহরণস্বরুপ বাবুই পাখির কথা বলা যায়। তাল গাছের মতো উঁচু গাছে নান্দনিক সৌন্দর্যের তৈরি বাসা একসময় মানুষ মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখতো। আজ তা বইয়ের পাতায়। এর কারণ সেই তাল গাছও যে প্রকৃতিতে অনেক কমে এসেছে। বাসা বানানোর উপযুক্ত জায়গার অভাবেই তাদের অস্তিত্ত্ব সংকটে রয়েছে। এরকম বহু পাখিই আজ দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু আজও এমন অনেক স্থান আছে যেখানে সকালের ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। আর যেসব স্থানে পাখির উপস্থিতি কমেছে সেখানে মোবাইলের রিংটোনে পাখির ডাক শোনা যায়। পাখির কদর আমরা বুঝি। সারা পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ লাখ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এসব পাখির অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্যস্থানে নিরাপদে চলে যায়। নিজের অবস্থান বিপদসংকুল হওয়ায় তারা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। শুধু এশিয়া আর ইউরোপে আছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি। পাখির সৌন্দর্য পাখির কলতান আমাদের পাখি প্রেমিকদের মুগ্ধ করে। শীত কাল শুরু হতেই মূলত আমাদের দেশে নানা বিদেশি পাখির ভিড় বাড়তে থাকে। দেশি পাখির পাশাপাশি তখন বিদেশ থেকে আসা এসব পাখি আমাদের হৃদয় কেড়ে নেয়। আমরা সমাদরে বরণ করে নেই এসব পাখীকে। সারা বাংলাদেশের মানুষ এখন জানে এসময় বিদেশ থেকে রংবেরঙের পাখি এদেশে এসে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এসব পাখিকে আমরা অতিথি পাখি বলি। এসব পাখিকে ঘিরে পাখি মেলাও অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এদের অতিথি পাখি বলি। সত্যি কথা বলতে বিদেশি পাখি হলেও প্রতিবছর আসা যাওয়ায় এরা আর অতিথি নেই। নামে অথিতি হলেও এরা আামদের দেশেরই অংশ হয়ে গেছে। এসব পাখির উদ্দেশ্যেই যেন পুরো একটি বছর অপেক্ষা করে থাকে পাখি প্রেমিকরা। এসব পাখি অতিথি হয়ে এলেও মনে হয় যেন নিজেদের দেশের সৌন্দর্যের একটা অংশ।
বাঙালি অতিথিপরায়ন জাতি হিসেবে সুপরিচিত। সে পাখিই হোক আর প্রাণি হোক আর মানুষ হোক। বঙ্গবাহাদুরের কথা আমাদের মনে আছে। সেই আদিকাল থেকেই অতিথি আপ্যায়নে বাঙালির প্রতিদ্বন্দী নেই। তাই শীতকাল শুরু হতেই যেসব পাখি ভিনদেশে থেকে আসতে শুরু করে তাদের নিয়ে উচ্ছল আনন্দে মেতে উঠি আমরা। জাহাঙ্গীরনগর ছাড়াও মোটামুটি দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব পাখি ভিড় করে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসব পাখি আমাদের দেশে আসে। মানে আশ্রয় নেয়। কারণ এই সময়ে সাইবেরিয়া সহ কয়েকটি শীতপ্রধান দেশের শীতের মাত্রা এতটা তীব্র থাকে যে তা এই পক্ষীকুল সহ্য করতে পারে না। পাখি প্রকৃতির এক অনবদ্য অংশ। সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তারা এদেশে এসে নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করে। শীতপ্রধান দেশের তীব্র শীত দেখা দেওয়ার সাথে সাথে খাবারের অভাব দেখা দেয়। সেই সাথে থাকে মারাত্বক তুষারপাত। তাই শীতে উত্তর মেরু,সাইবেরিয়া,ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু অংশে প্রবল তুষারপাত থাকে। এই তীব্র তুষারপাতে এসব পাখি তাদের অস্তিত্ত টিকিয়ে রাখতে পারে না। তাই নিজেদের অস্তিত্ত রক্ষায় তারা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে এবং বাংলাদশের মত অপেক্ষাকৃত কম শীতের দেশে উপস্থিত হয়।
শীতকালে বাংলাদেশে আসা পাখিদের মধ্যে অনেক রকম পাখির নাম পাওয়া যায়। স্বচ্ছ পানির বালি হাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস পাখি, বড় সারস পাখি, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্ত প্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও নানা রং আর কণ্ঠ বৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি পাখির নাম বিভিন্ন তথ্য থেকে পাওয়া যায়। এসব পাখি নান রঙের ও আকারের। দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়ায়
প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জীববৈচিত্র রক্ষায় অতিথি পাখির অবদান অনেক। অতিথি পাখির প্রতি যেমন আমাদের দায়িত্ব রয়েছে তেমনি রয়েছে আমাদের দেশী প্রজাতির পাখির অস্তিত্ত্ব রক্ষার প্রতি দায়িত্ব। দোয়েল,কোয়েল,ময়না,শ্যামা,টিয়া,শালিক,ফিঙে,চড়ুই,টুনটুনি,বুলবুলি আরও কতশত পাখি। এসব পাখির সাথে আমাদের বাংলার রুপ জড়িয়ে আছে। কত গল্প,গান আর কবিতায় উঠে এসেছে পাখির কথা তার ইয়ত্তা নেই। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য পাখির বিভিন্ন প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে কৃষিতে ব্যবহৃত পাচিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে ক্ষতিকারক কীট ধ্বংস করা সহজ হচ্ছে। এসব কারণে পাখিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। পাখি যারা শিকার করে তারা কেউ ভোজন রসিক আবার কেউ জীবিকা অর্জনের জন্য পাখি শিকার করে আবার কেউ নেহায়েত শখের বশেও পাখি শিকারের মতো জঘণ্য কাজ করেন। যারা এটা করছেন তারা অধিকাংশই সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেই পরেন। নিজেদের স্বার্থেই অতিথি পাখি শিকার রোধ করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে পাখি প্রকৃতির অংশ। এই অংশ বাদ দিয়ে প্রকৃতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। পাখির অস্তিত্ত লোপ পাওয়ার সাথে সাথে নিজেদেরও আমরা নানা বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। পাখি শিকারীরা যাতে পাখি শিকার থেকে বিরত থাকে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। কারণ সবক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ সম্পূর্ণ সফলতা আনতে পারে না। যদি পাখি শিকারীদের এটা বোঝান যায় যে পাখি শিকার করা অন্যায়ের সাথে নিজেদের জন্য ক্ষতিকর তাহলে এ প্রবণতা কমে আসবে। প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই একটি শিশুকে জীবের প্রকৃতির প্রতি, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা,মায়া-মমতার অনুভূতি জাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
অলোক আচার্য শিক্ষক ও কলামিষ্ট