পথশিশু নয় মানবসম্পদ

0
468

ড. মো. আনিসুজ্জামান
জন্মের জন্য কোনো মানবশিশু দায়ী নয়। শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না। শিশুকে নিয়ে আসা হয়। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সঙ্গম নারী-পুরুষ মিলে শিশুর জন্মদান প্রক্রিয়া সম্পাদন করে। পুরুষ ছাড়াও স্পার্ম ব্যাংকের সহযোগিতায় মানবশিশুর জন্ম হচ্ছে। সব শিশু পরিকল্পিতভাবে জন্মায় না। জন্মশাসন পদ্ধতি জনপ্রিয় হওয়ার পরও সব শিশু যে পরিকল্পিতভাবে জন্মায় এমন নয়। কখনো কখনো অপরিকল্পিতভাবে জন্মায়। বিশেষ করে পথশিশুদের অনেকের বাবার কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। পথে জন্ম নেওয়া শিশুটি পথেই বড় হয়। পথই তার সমাজ সংসার কলরব। রেলস্টেশনে, বাস, লঞ্চ টার্মিনালে অনেক মায়ের কোলে শিশুসন্তান দেখা যায়। বাবা দায়িত্ব নেয়নি। মা সন্তানকে বড় করছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত রাষ্ট্রের এক মানব। সমাজ-রাষ্ট্র দায়িত্ব নেয়নি। সামাজিক সব ধরনের বঞ্চনা নিয়ে বেড়ে উঠে এক মানবসন্তান। জন্মই যেন আজন্ম পাপ। মাতৃ জরায়ু থেকে নেমেই বোঝে যায় দুনিয়া কত কঠিন, কত নির্মম-নিষ্ঠুর। পথে পথে ঘুরে কখনো পরিচয় টোকাই হিসেবে, কখনো বা পিচ্চি। এই মানবশিশু থেকে কিশোরদের অনেকে সামাজিক নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। কখনো ছিঁচকে চোর, কখনো বা মাদকসেবী। অথচ রাষ্ট্রের সামান্য সহযোগিতায় পথশিশুরাও সমাজে রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। পথশিশু পরিণত হতে পারে দক্ষ মানবসম্পদে।
বর্তমান মানুষের জন্মের দশ লাখ বছর আগে হোমো হাবিলিস, হোমো রুডলফেসসিস, হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়েনডারথেল এ রকম আরো কিছু মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল। বর্তমান সময়ের মানুষের নাম হোমো স্যাপিয়েন্স। হোমো স্যাপিয়েন্সের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবর্গ ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা অর্গানিক লাইফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যেকোনো একটি সফল হতে পারে। একসঙ্গে কিংবা কিছু সময়ের ব্যবধানে তিনটিই আলোর মুখ দেখতে পারে।
সাইবর্গ ইঞ্জিনিয়ারিং হলো এমন বিষয়, যা অর্গানিক এবং নন-অর্গানিকের সংমিশ্রণ। এর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রাকৃতিক বুদ্ধির স্থান দখল করবে। কিন্তু এটাও ঠিক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষই সৃষ্টি করেছে। সৃষ্ট কি স্রষ্টাকে ধ্বংস করবে? কম্পিউটার, ফেসবুক, টুইটার, ইন্টারনেট জ্ঞানী মানুষের জীবন-ভাবনায় অনেক পরিবর্তন এনেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর ম্যানুয়াল অনেক কাজ আর জ্ঞানী মানুষকে করতে হবে না। সাইবর্গ প্রকৌশলীরা বায়োনিক জীবন সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। আমরা বায়োনিক হাতের কথা জানি। বায়োনিক জ্ঞানী মানুষ সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। শ্রবণশক্তিহীন মানুষের কানে যন্ত্র লাগিয়ে শ্রবণক্ষম করা যাচ্ছে। পেসমেকার লাগিয়ে হৃদ্যন্ত্র কার্যকর করা হচ্ছে। চশমা দিয়ে অল্প দৃষ্টিশক্তির মানুষ দেখার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। এগুলো সবই সাইবর্গ ইঞ্জিনিয়ারিং। কৃত্রিম কিডনি আবিষ্কারের কথা শুনি। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি খবর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। একটি মেয়ে হৃৎপিণ্ড পিঠের পেছনে ব্যাগের মধ্যে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা যাবে। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করার সক্ষমতা মানুষ অর্জন করতে পারে। বায়োনিক কান ইতোমধ্যে আবিষ্কার হয়েছে। জার্মান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত কম্পানি ‘রেটিনা ইমপ্লান্ট’ কৃত্রিম রেটিনা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। এই রেটিনার সাহায্যে দৃষ্টিহীন মানুষ পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার সুযোগ পাবে। আমাদের দেশে মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মধ্যে কৃত্রিম পা সংযোজন করে একজন মানুষ সাধারণভাবে চলাফেরা করতে পারে। এসবই সাইবর্গ। আমরা সাইবর্গের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। সাইবর্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট হলো মানুষের মস্তিষ্ক এবং কম্পিউটারের মধ্যে একটি সরাসরি দ্বিমুখী সাধারণ যোগাযোগ ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা, যা কম্পিউটার মস্তিষ্ক প্রেরিত সংকেত পড়তে এবং মস্তিষ্কে সংকেত পাঠানো যাবে এবং মস্তিষ্ক সেটি পাঠ করতে পারবে। যদি এর মাধ্যমে মস্তিষ্ককে সরাসরি ইন্টারনেটের সাহায্যে অন্য মস্তিষ্ক এবং কম্পিউটারের সঙ্গে যোগ করা যায়, তাহলে অন্য মস্তিষ্কের হারিয়ে যাওয়া তথ্য উদ্ধারে সহায়ক হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে স্যাপিয়েন্স কি আর স্যাপিয়েন্স থাকবে? অর্গানিক থাকবে না। অন্য কিছু হবে। এই অন্য কিছুর সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক মূল্য কী হবে আগে থেকে অনুমান করা অসম্ভব। তবে নতুন কিছু এই গ্রহে আসছে এটিই সত্য। এটিই পরিবর্তন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। নদীর তলদেশে টানেলের নির্মাণের কাজ চলছে। মেট্রো রেল চলাচল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। উন্নত বিশ্বের মতো মাটির নিচ দিয়ে রেল চলাচল করবে কখনো। দ্রুতগতির রেল নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা সেতু। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। মহাকাশে আমাদের স্থান হয়েছে। সমুদ্রসীমা বিজয় হয়েছে। নতুন নতুন যুদ্ধজাহাজ আসছে। বিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিপরীতে সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিসীমার আড়ালে থেকে যাচ্ছে বহু মানবসন্তান।
দেশের সর্বত্র নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি রাস্তায় দেখা যায়। এমন অনেক শিশু আছে, যাদের জন্য দুই থেকে তিনটি গাড়ি বরাদ্দ থাকে। সময় করে গৃহশিক্ষক আসে, যায়। স্কুলের বেতন লক্ষ টাকার ওপর। এর বিপরীত চিত্র মাঘের শীতে খোলা আকাশের নিচে মা কোনো রকমে একটু গরম কাপড় জড়িয়ে আদরের ধনকে নিয়ে শুয়ে আছে। শিশুটি নিশ্চিতে-নিরাপদে ঘুমাচ্ছে। শিশুটি জানে এটিই তার দুনিয়া। শুভেন্দু মাইতির একটি গানের কথা, ‘তোমার নুহর জন্ম দিনে খাইচ্ছ কত পায়েস। আমার নুহর জন্ম দিনে অরন্ধনের আয়েস’। বিশাল ব্যবধান শুধু জন্মসূত্রে পাওয়া। বিপুল ব্যবধানের সমাজে আমরা বড় হয়ে উঠছি শুধু দেখে দেখে। একদিকে বিলাস অন্যদিকে বঞ্চনা। বৈষম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় শিশুমনও আক্রান্ত হয়। ক্ষত-বিক্ষত হয়। একদিকে কোটি টাকার গাড়ি, অন্যদিকে অরন্ধন বজায় রেখে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জনপ্রিয় স্লোগান ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা কত? প্রতিবছর কতজন শিশু নতুন করে পথের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে? অনুমান করি পথশিশুর সংখ্যা বেশি নয়। সরকারের সদিচ্ছার ওপর পথশিশুদের সুন্দর জীবন নির্ভর করছে। পথশিশুদের সামান্যতম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মূলধারার ফিরিয়ে এনে মানবসম্পদে পরিণত করা যায়। পথশিশুদের পথে রেখে মধ্যম আয়ের দেশে আরো বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। গুলশান, বনানী আর ধানমণ্ডি যেখানেই থাকুন না কেন, অস্থির সমাজব্যবস্থায় কেউ নিরাপদ নয়। শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তা সে সোনার চামচ নিয়ে জন্ম হোক অথবা পথেই থাকুক। রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই সব শিশুকে সমান সুযোগ-সুবিধার আওতাভভুক্ত করা উচিত। এই শিশুরাই আগামী দিনের সোনার বাংলা গড়বে। দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারি, ব্যাংক লুণ্ঠনকারী, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি অসৎ পরিবারের সন্তানরা উন্নত বিশ্বে অভিবাসী হলেও পথশিশুরা দেশেই থাকে। এদের নিয়ে ভাবার সময় এখনই।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়