নির্ভয়ারা কোথাও নিরাপদ নয়

0
310

ভারতের নির্ভয়ারা নির্ভয়ে থাকতে পারে না। দীর্ঘ সাত বছর পর নির্ভয়াকান্ডে দোষীদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। নির্ভয়ারা সাত বছর আগেও যেমন নির্ভয়ে থাকতে পারেনি আজ পারেনা। এদেশের নির্ভয়ারাও নির্ভয়ে থাকতে পারে না। নির্ভয়াদের মতো আমাদের তিশা, তনুদেরও এক অবস্থা। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কখন, কোথায় কিভাবে নির্যাতনের শিকার হবে তা কেউ বলতে পারে না। আমাদের নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা তালিকাও ক্রমেই বাড়ছে। থামছে তো না উপরন্তু প্রতিটি ঘটনাই বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সবাই যখন উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়েও কেউ না কেউ ধর্ষিত হচ্ছে। কে যে ধর্ষক আর কে যে মানুষ তা নির্ধারণ করা আজ আর সম্ভব নয়। নতুন বছরের কয়েকদিন পেরোতেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। বিকৃত মানসিকতার মানুষেরা তাদের বিকৃত কাম চরিতার্থ করতে শুরু করেছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে শিক্ষার্থীরা। রাজশাহীতে তিন সহপাঠী মিলে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে। গতবছর দেশে দেড় হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের ঘটনা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জন নির্যাতিতকে। এছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। পত্রিকার পাতায় সে খবর আমরা পাই। এরই মধ্যে কোনো কোনো ঘটনায় দেশের শুভ চেতনার মানুষ রাস্তায় নামে। প্রতিবাদ জানায়। তারপও আবার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। অদৃশ্য দানব চেপে বসছে আমাদের মাঝে। ধর্ষকদের আইনেরও আওতায় আনাও হচ্ছে। শাস্তিও হচ্ছে। তাও যেন কোনোভাবেই ধর্ষণের ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। এটা এখন মানসিক বিকৃতির চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে। ঘরে, রাস্তায়,দোকানে,চাকরিতে,স্কুল-কলেজে কোথাও তারা নিরাপদ নয়।
একসময় দেশে নারীদের স্তন কর দিতে হতো। প্রত্যেক নারীকে তার স্তনের জন্য জমিদারকে কর দিতে হতো। একদিন কোন এক নারী স্তন কর পরিশোধ করতে না পারায় জমিদারের পেয়াদা এসে হাজির হয়। অসহায় সেই নারী তখন তাদের বাইরে দাড় করিয়ে রেখে ভেতরে গিয়ে তার স্তন দুটো কেটে কলাপাতায় এনে তাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর অবশ্য ঘটনাস্থলেই সেই অভাগা নারীর মৃত্যু হয়। আর তারপর থেকে উঠে যায় স্তন কর। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে । ধর্ষণের সাথে সাথে নারী অত্যাচারের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এটা একটা ভাইরাসের মত ছড়িয়ে চলেছে। শুধু প্রতিষেধকটা জানা নেই। একজন দুইজন করে প্রতিদিন সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণ মানে তো শারিরীক মৃত্যু নয়। তবে তা মানসিক মৃত্যু। বেঁচে থেকেও সে মরে থাকে। আবার ধর্ষণের পর মুখ বন্ধ করতে মেরেও ফেলছে। নৃশংস থেকে নৃশংসতম ঘটনা আমরা দেখে চলেছি। সভ্য সমাজে অসভ্য বর্বদের পদচারণায় ক্রমেই ধরণী ভারী হয়ে উঠছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার যেন কোন উপায় নেই। পশুবৃত্তি যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে চেপে বসেছে যেন সেখান থেকে আলোর পথ দেখিয়ে মনুষ্যত্ব পথ দেখানোর কেউ নেই। সমাজে ধর্ষণকারীদের দাপটই বেড়ে চলেছে। পাকিস্থানীরাও একসময় এদেশের লাখ লাখ মা বোনের ইজ্জত নিয়েছিল। তোরা নাকি নারীদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটেও নিত। বেয়নেট দিয়ে খচুচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাত্ত করতো তাদের যৌনাঙ্গ। কিন্তু তারা তো পাকিস্থানী ছিল। ইতিহাসে ওদের বর্বর বলেই স্বাক্ষি দেয়। কিন্তু আজ যা হচ্ছে তা করছে কারা। এদেশেও আজ ধর্ষণের পর মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। এটা আমাদের কাম্য বাংলাদেশ নয়। এসব বিকৃত মনের মানুষ সোনার বাংলা গড়ার অন্তরায়। নিজ দেশের চেনা মুখগুলোর কাছে প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হতে হবে স্বাধীন দেশের কেউ তা ভেবেছিল। ভাবেনি মনে হয়। আর ভাবেনি বলেই কবি শামসুর রহমান তার কবিতায় লিখেছেন স্বাধীনতা তুমি গ্রাম্য মেয়ের অবাধে সাতার। যেখানে সমাজের আনাচে কানাচে ধর্ষণকারী ঘুরে বেড়ায় সেখানে অবাধে সাতারের প্রশ্নই আসে না। আমাদের মেয়েরা তো বন্দি।
অনেক ক্ষেত্রেই আজকাল আবার পরোক্ষভাবে ধর্ষিতার দিকেই অভিযোগের আঙুল তোলা হয়। আসলে সাপ যাকে কোনদিন দংশন করেনি সে কি পারে বিষের যন্ত্রণা অনুভব করতে। যে পরিবারের একটা মেয়ে ধর্ষণে শিকার হয় সেই পরিবারই যন্ত্রণা বোঝে। কারণ সমাজটা বড় অদ্ভূত। ধর্ষিতাকেই নানা কটু কথা শুনতে হয়। আবার ধর্ষকদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। মেয়েটার কত দোষ চোখে আঙুল দিয়ে বের করে দেয়। এই সাফাই গাওয়ার প্রবণতা ধর্ষকদেও উৎসাহ দেওয়ারই নামান্তর। কিন্তু আমরা তো একটা ধর্ষণকারী মুক্ত সমাজ চাই। ধর্ষণ তো কামের কুপ্রবৃত্তির চুরান্ত রূপ। কামের বশবর্তী হয়ে ওরা যে সমাজটাকেই ধর্ষণ করে চলেছে তার খবর ওরা রাখে না। সভ্য সমাজে অসভ্য হায়েনার নাচ আর কতকাল দেখতে হবে কে জানে। অবশ্য সভ্যতার দোহাই দিয়ে আজকাল আমরা যা করছি তাতে আর নিজেদের সভ্য বলা যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। যারা ধর্ষক বা অত্যাচারকারী বা নির্যাতনকারী তাদেরও কি বোন নেই। তারাও কি তার ভাইয়ের মত অন্য কাউকে ভয় পায়। সে কি আদৌ জানে তার পরিচিত মুখ কতটা ভয়ংকর। অনেক পরিবারে মেয়ে জন্ম হলে যেন পরিবারে আনন্দিত হবার বদলে কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যেত এবং আজও যায়। কন্যাশিশু জন্ম হওয়াতে পরিবারের সবার কপালে এই ভাঁজ পরতো। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিল পদে পদে নিষেধাজ্ঞা। তাদের পৃথিবী ছিল ছোট। আজ তাদের চলায় সেসব বাধা নেই। তবে চলার পথ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বিপদের শংকাও বেড়েছে বহুগুণ। আগে মেয়েদের এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না। এখানে মেয়েদের থাকা ঠিক না বা মেয়েরা এ কাজ করতে পারে না। তাদেরকে নানাভাবে ছোট করা হয়েছে, বানানো হয়েছে পুতুল। আগেই বলেছি পোশাকে হয় না, সভ্যতা হয় মনে। মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন অসম্ভব। মেয়েদের ভোগের বস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার আগে একবার নিজের পরিবারের দিকে তাকাই। আজ যারা ধর্ষণ করছে তাদের পরিবারের মেয়েদের লজ্জা অনেক বেশি। তারা তো জানতোও না যে তার আশেপাশেই এরকম একজন ধর্ষণকারী ঘুরে বেরাচ্ছে। সমাজে ধর্ষণের ঘটনা কমাতে হলে আমাদের কি করতে হবে তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে,হচ্ছে। কিন্তু ধর্ষণের মতো ঘটনা থামছে না। ধর্ষকরা কাউকেই ভয় পায় না। শাস্তির ভয়ও তাদের দমিয়ে রাখতে পারছে না। এটা সমাজের দুর্বলতা নাকি আমাদের নীতি নৈতিকতার দায়। সেই অদৃশ্য দানব ক্রমেই চেপে বসছে আরও বেশি মানুষের মাঝে। তারপর তাকে মানুষ থেকে অমানুষ করে তুলছে। আমাদের হিংস্র চোখ হিংস্রতার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। তারপর যখন যেখানে সুযোগ পায় নিজের হিংস্রতা ফলায়। সেই হিংস্রতায় ক্ষত বিক্ষত হয় আমাদেরই কোনো বোন। নারীদেহ কেবলই ভোগের জন্য এই মানসিকতা থেকেই আজও আমাদেরই অধিকাংশই বের হতে পারেনি।
একটি সমাজ তার নিজস্ব গতিধারায় চলে। ইতিহাস স্বাক্ষী আছে সেই ধারায় সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে নারীরা। আজও যতই অধিকারের কথা বলা হোক অবস্থার উন্নতি খুব বেশি হয়নি। মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারিনি। সমাজের সেই গতিধারা ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে তা নির্ভর করবে সেই সমাজের মানুষের ওপর। আমাদের মানবিক গতিধারা এখন নেতিবাচকভাবেই প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা সেই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছি। কিন্তু এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন যে ঘটনাই ঘটুক আমরা তা প্রতিরোধ করতে পারছি না। তার কারণ আমরা এটাই জানি না আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর কে কতটা মানবিক বা কার ভেতর কখন সেই নিষ্ঠুর দৈত্য জেগে উঠবে তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে আমরা তা ঠেকাতে পারছি না। এর থেকে স্থায়ী প্রতকিার পেতে হলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিবেকহীন,নিষ্ঠুর,হিংস্র মানুষ যে সমাজ থেকে একেবারে নির্মুল করা সম্ভব হবে তা বলা যায় না। শরীরে যেমন রোগের জীবাণু থাকবেই, তার যেমন প্রতিষেধক আছে তেমনি ধর্ষণ নামক এই ব্যাধীরও প্রতিষেধক আছে। তা খুঁজে বের করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

অলোক আচার্য
কলামিষ্ট