নারী দিবস ও নারীর ক্ষামতায়ন

0
684

দীপক রায়
‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা, জাগো সাহা সিমন্তে রক্ত টিকা’।

আজ আন্তর্জাতিক নারীদিবস। বাংলাদেশের মত পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে দিবসটি পালনের মধ্যদিয়ে মানুষ হিসেবে নারীদের সমান অধিকারের কথা ধ্বনিত হচ্ছে। প্রতিবছর দিবসটি পালনের পূর্বে একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো; নারী পুরুষ সমতায় নতুন বিশ্ব গড়ো’। উক্তিটি উদ্ভাবনী উপায়ে লিঙ্গ সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, জনসাধারণের পরিসেবাগুলিতে এবং টেকসই অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ফোকাস করবে। কাংখিত সাষ্টেনিবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জনের জন্য পরিবর্তিত শিফট, সমন্বিত পন্থা এবং নতুন সমাধান দরকার, বিশেষকরে যখন লিঙ্গ সমতা বাড়াতে এবং সমস্ত নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন আসে।

এমনি করে প্রতি বছর ৮ মার্চ আসবে, আসবে নতুন বাক্য কিন্ত কথা হলো বর্তমান সভ্যতার সাথে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা, নারীর প্রতি বৈষম্যহীনতা অর্থাৎ নারীকে মানুষ হিসেবে আমরা যে মর্যাদার জায়গায় দেখতে চাই সেখানে কি আনতে পেরেছি? এ নিয়ে মানুষের দুই ধরনের মতবাদ আছে, এক শ্রেণির মানুষ মনে করেণ নারী নির্যাতন পূর্বের তুলনায় বেড়েছে শুধু ধরনটা পরিবর্তন হয়েছে। অন্যরা মনে করেণ নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন পূর্বের তুলনায় কমেছে। প্রশ্ন হলো একজন পুরুষ যেমন মানুষ, একজন নারীও মানুষ তাহলে শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সৃষ্ট বৈষম্যকে আমরা দূর করতে কেনো সক্ষম হচ্ছে না। যুগযুগ ধরেই নারী নির্যাতনের বিভিন্নœ ইতিহাস মানুষকে যেমন শিহরিত করেছে তেমনি সভ্যতাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। আসলে নারীদের নিয়ে আমরা কি ভাবি, তাদের সঙ্গে আমরা কি ধরণের আচরণ করি এবং নারীরা-এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে কি করেছে এর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

গত ১৫-০৩-৯৯ ইত্তেফাকে রাবেয়া সুলতানা ডেইজি লিখেছিলেন ‘মেয়েদের কোন আত্মা আছে কিনা এ সম্পর্কে সন্দেহ ছিল ইউরোপবাসীদের। নারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডে এক বিচার সভাও গঠন করা হয়েছিল’। নারীদের চেয়ে দুনিয়াতে আর কোন নিকৃষ্ট বস্তু নেই এ ছিল খ্যাতনামা প-িতদের বক্তব্য। গ্রীকদের মতে, সাপে কামড় দিলে বা আগুনে পুড়ে গেলে চিকিৎসা করা সম্ভব কিন্তু নারীর অনিষ্টের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। তৎকালীন ইরানে স্ত্রী ও বোনের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। ভারতে যে সতীদাহ প্রথা ছিল তা মানুষকে আজও ব্যথিত করে। গ্রীকচিন্তাবীদ ডেমিস্তিনিস বলেন, ‘আমরা যৌন তৃপ্তির জন্য গণিকালয়ে যাই এবং সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য স্ত্রী গ্রহন করি’।

আজ যারা আমাদের কাছে নারী মুক্তির আন্দোলন ও মানবাধিকারের বারতা নিয়ে এসেছেন তারাও ১৪শত থেকে ১৭শত শতকের মধ্যে ইউরোপে প্রায় ৫ লাখ নারীকে ডাইনী সাজিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। প্রকৃত পক্ষে দুইহাজার শতকে রূশ বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রগতি ইউরোপে নারী স্বাধীনতার নতুন ধ্যান ধারণা নিয়ে আসে যা প্রথমে ইউরোপের নারীদের উদ্বুদ্ধ করে। এর মধ্যে দু’টি বিশ্ব যুদ্ধ, যুদ্ধাকালীন সংকট, সামরিক প্রয়োজন ও ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি পুনরূদ্ধার প্রচেষ্টার কারণে ইউরোপে নারীদের কর্মসংস্থানের দ্রুত প্রসার ঘটে। সেখানেও সুখ নেই, নারী মুক্তির নামে যে কর্ম ব্যস্ততা তারও প্রধান লক্ষ্য পুঁজির বাজার ঠিক রাখা, বিস্তৃত করা, প্রবৃদ্ধি ও মুনাফা নিশ্চিত করা। আর তাই উৎপাদনশীলতাই নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান শর্ত বলে চিহ্নিত হয়েছে।

উৎপাদনের স্বার্থে নারীকে ব্যবহার করা হলেও নারীর উপর অত্যাচার কমেনি। এমন সমাজ ব্যস্থার বিরুদ্ধে নারী সমাজ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ৮ মার্চ। আমেরিকার শিকাগো শহরে কারখানার মালিকগণ নারী শ্রমিকদের ১২-১৬ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করেন। অথচ মজুরী দিত খুবই কম। অমানবিক খাটুনি ও নির্যাতন ক্রমেই নারীদের প্রতিবাদমুখী করে তোলে। নারীরা ন্যায্য মজুরী ১২-১৬ ঘন্টার পরিবর্তে ৮ ঘন্টা কাজ করার অধিকার আদায়ের মিছিল করে। কিন্তু মালিকরা নারীদের এ মিছিল থামিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ লেলিয়ে দেয়। সেদিন পুলিশের হাতে বহু প্রতিবাদী নারী লাঞ্চিত এবং আহত হয়। ৮ মার্চের এ ঘটনার খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে এসব নারীরা দ্বিতীয় আন্তর্জতিক নারী সম্মেলনে যোগ দেন। সে সম্মেলনে যোগ দেন জার্মান দেশের সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লেরা স্বেতকীন। তিনি নারীদের বিভিন্ন দাবি, সংগ্রামে সংহতি ও ঐক্যের প্রতীক হিসাবে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারীদের দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। এরপর সারা দুনিয়ায় নারী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সেখান থেকেই নারীর অধিকার আদায়, তাদের প্রতি নির্যাতন বন্ধ এবং সমস্ত বৈষম্য দূর করার দাবিতে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

সত্যিকার অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন না হলে নারীর ওপর অত্যাচার থামবে না বরং বাড়বে। যুগের সাথে নারী নির্যাতনের ধরণ পাল্টেছে, পাল্টেছে নারীলোভি হায়েনাদের নিশানা। নারীরা শারিরিক, মানসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সবদিক থেকে নির্যাতিত হচ্ছে। নারী শ্রমিকরা আজও ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত। অত্যন্ত লজ্জাজনক হলেও সত্য বর্তমান বিশ্বে নারীরা রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মস্থলে, পিত্রালয়, শ্বশুরবাড়ী সবখানে কমবেশী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে যা প্রতিনিয়ত আমরা গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনের মাধ্যমে অবগত হই। এর অনেকেটাই আবার রয়ে যায় অন্ধকারে। বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য সরকার কঠোর আইন করেছে তারপরও লুকিয়ে চুরি করে বাল্যবিয়ে হচ্ছেই । পাচারের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। শিশুশ্রম এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি। কন্যা শিশুর জন্ম হলে এখনও অনেক পরিবার খুশী হতে পারে না। আমাদের দেশে এখনও বেশ কিছু সম্প্রদায়ের মানুষের সমাজ ব্যবস্থায় পৈতৃক সম্পদে মেয়েদের কোন অংশ দেওয়া হয় না। যৌতুক এখন আর কাউকে জানিয়ে দেওয়া হয় না নিরবে দুই পরিবার নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নেন। দেশের প্রচলিত আইনকে অবমাননা করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদেরকে ঠকানো হচ্ছে। এর থেকে নারীদের পরিত্রাণ কোথায়? বিষয়টি সকলকে ভাবতে হবে শুধু সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বিবেচনায় এনে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে। যে নারী পৃথিবীতে আবিস্কার করেছিল কৃষি ব্যবস্থা, যে নারী তৈরী করেছিল আজকের সভ্য মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্র তারা আজ নিদারুন বৈষম্যের শিকার! শুধু কাগজে কলমে নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতা দিলে চলবে না। এর সঠিক বাস্তবায়ন দরকার।

প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহনের জন্য এখনও সংরক্ষিত আসনটি রয়েছে। এটি এমনভাবে সাধারণ জনগণের মগজে ভর করে বসেছে যে, নারীরা সাধারণ আসনে অংশগ্রহন করলেও অধিকাংশ ভোটার মনে করেণ নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন, সাধারণ আসন নয়। তাই অনেক বেসরকারী সংস্থা সাধারণ আসনে নারী প্রার্থীতার বিষয়ে কাজ করে এখনও সফল হতে পারেনি। একটি ইউনিয়ন পরিষদে তিনটি ওয়ার্ড মিলে একটি সংরক্ষিত আসন আর পুরুষদের জন্য রয়েছে একটি ওয়ার্ড অর্থাৎ নারীরা তিনটি ওয়ার্ডের ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হন আর পুরুষ সদস্যরা একটি ওয়ার্ডের ভোটে নির্বাচিত হন। সেখানে একজন পুরুষ ইউপি সদস্যের থেকে একজন নারী সদস্যের পদমর্যাদা এবং ক্ষমতা একটু উন্নত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে আমরা কি দেখি। ইউনিয়ন পরিষদে একজন নারী সদস্যকে কতটুকু মূল্যায়ন করা হয় তা ভুক্তভোগী সকল নারী সদস্যরা জানেন। আমাদের জাতীয় সংসদেও এখনও সরকার দলের মনোনয়নের মাধ্যমে নারী সদস্য নির্ধারণ করা হয়। সেখানে একজন সরাসরি গণভোটে নির্বাচিত সাংসদ এবং মনোনীত এমপিদের ক্ষমতার দূরত্ব কতখানি সেটি সকলের কাছে দিবালোকের মত পরিস্কার। এসব দেখে মনে হয় নারীর ভাগ্য এখনও পুরুষদের দয়া এবং খাম-খেয়ালীর উপর নির্ভর করছে। এ খাঁচা না ভাঙ্গলে নারী দিবস এলে আমরা যত হৈচৈ করি না কেনো সব হবে লোক দেখানো মিথ্যা এবং বানোয়াট। তাই আজকের দিনে আমাদের শপথ হোক নারীকে নারী হিসেবে নয় একজন মানুষ হিসেবে চিনতে শিখি। নারীকে পিছিয়ে না রেখে তাদের যোগ্য ক্ষমতায়ন করি তাহলে সমাজ থেকে দূর হবে নারী নির্যাতন। নারী ও পুরুষের সমান চেষ্টায় শান্তি ও কল্যাণময় হবে আগামীর পৃথিবী। যেখানে শিশুরা পাবে মায়ের অকৃত্রিম স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, বিকশিত হবে তারা আর বিকশিত শিশুরাই হবে জাতির যোগ্য ভবিষ্যৎ।

                                                                          লেখক : একজন উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিককর্মী।