ধরাছোঁয়ার বাইরে পুলিশ ও পৃষ্ঠপোষক : মাদক বিরোধী অভিযান

0
706

বিমল সাহা :

নগরীর মাদক নির্মূলে দিনরাত পুলিশের অভিযান চলছে। এই সকল অভিযান শুধুই বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে। মাদকের সাথে জড়িত পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযুক্তদের তালিকা পাওয়ার পরও পুলিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এমনকি অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরাই মাদক বিরোধী অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর তালিকায় থাকা দলীয় নেতাকর্মিরাও বহাল তবিয়তের রয়েছেন। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে মাদকের এই অভিযান কতটা ফলপ্রস্যু হবে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পর থেকেই মহানগর ও জেলা পুলিশ একযোগে মাদক বিক্রেতাদের ধরতে দিন রাত অভিযান পরিচালনা করছেন। প্রতিদিনই একাধিক মাদক বিক্রেতা গ্রেফতারের পাশাপাশি বিপুল পরিমান মাদক উদ্ধার হচ্ছে। ইতোমধ্যে খুলনায় বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হয়েছেন। নগর ও জেলায় এপর্যন্ত শতাধিক মাদক বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকীরা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র গা ঢাকা দিয়েছে। বড় বড় ডিলার ও ব্যবসায়ীরা কেউ মামলা নিয়ে জেলে আবার কেউ দেশ ছেড়ে ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন। অভিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখনও বহালতবিয়তে স্ব স্ব কর্মস্থলে দায়ীত্বরত আছেন। পৃষ্ঠপোষক ও রাজনৈতিক নেতারাও বুক ফুলিয়ে নিজ এলাকায় দাপটের সঙ্গে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তালিকায় থাকা পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। বর্তমানে নগর ও জেলায় বিক্রেতাদের ধরতে যে অভিযান চলছে তা পূর্বেও চলমান ছিল। তাই নতুন করে শুধুমাত্র বিক্রেতাদের গ্রেফতারের মাধ্যমে সাময়িক মাদক নিয়ন্ত্রন সম্ভব কিন্তু নির্মূল সম্ভব নয় বলে মত দিয়েছেন অভিজ্ঞজনেরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন’র জেলা সম্পাদক এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা বলেন, মাদক বিক্রেতা ও তাদের যারা সহায়তা করছে উভয়কেই আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় দেশব্যাপী মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের এই অভিযান বিতর্কিত হতে পারে। এছাড়াও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার নতুবা মাদক নির্মূল কোনভাবেই সম্ভব নয়। এসকল অভিযানে শুধু সাময়িক মাদক নিয়ন্ত্রন সম্ভব।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া উইং এডিসি সোনালী সেন বলেন, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করা হবে। এই তদন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সুপার এস, এম, শফিউল্লাহ বলেন, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই বাছাই চলছে। যেকেউ দোষী সাবস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ফুলতলা থানার এএসআই মোস্তাফিজকে বদলি করা হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ বলেন, অভিযুক্ত দলীয় নেতাকর্মিদের বিরুদ্ধে খোজ খরব নেওয়া হচ্ছে। মাদকের সাথে কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবিষয়ে কেন্দ্রের কঠর নির্দেশনা রয়েছে।
নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, তালিকায় নাম থাকলেই আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। দলীয় নেতাকর্মিদের মধ্যে তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা সকলেই মাদকের সাথে জড়িত এটা সঠিক নয় বলেও তিনি মনে করেন।
জেলা বিএনপি’র সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, সরকারের এই মাদক অভিযানের নামে ক্রস ফায়ার দিয়ে মানুষ হত্যা করা এটা আমরা মোটেই সমর্থন করি না। বিএনপির কোন নেতাকর্মির নাম তালিকায় আছে সেটা জানা নেই। তবে মাদকের সাথে জড়িত দলীয় কোন নেতাকর্মিকে ছাড় দেওয়া হবেনা। সরকার দলীয় নেতাকর্মিরাই বেশি মাদকের সাথে জড়িত বলে তিনি মনে করেন।
সম্প্রতি মাদক বিক্রেতা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পেশাজীবী সংঠনের অনেকের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। খুলনার নয়টি উপজেলায়  সরাসরি মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে ১১৮ জন, আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারী ১২ জন ও ১২ পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে। কেএমপির আট থানা এলাকার সরসরি মাদক বিক্রির সাথে জড়িত ১৫৪ জন, আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারী ২৮ জন ও ২২ জন পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অঙ্গসংঠনের সমর্থক ও দলীয় নেতাকর্মিও নাম রয়েছে।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, তালিকায় প্রকাশিত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল তদন্ত চলছে। এছাড়াও বিভিন্ন মহলের সাথে কথা বলে তাদের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে। কেএমপির সদর থানার সদর থানার এসআই টিপু সুলতান, এসআই মিলন কুমার, এসআই শাহ আলম, এসআই শুব্রত কুমার বাড়ৈ ও এসআই আশরাফুল আলম, সোনাডাঙ্গা থানার এস আই সোবাহান, এএসআই এমদাদুল হক ও এএসআই নুরুজ্জামান, দৌলতপুর পুলিশ ফাড়ির এস আই মোঃ মিকাইল হোসেন ও দৌলতপুর থানার এএসআই মোঃ মেহেদী হাসান, খালিশপুর থানার এসআই কানাই লাল মজুমদার ও এস আই নুরু, খানজাহান আলী থানার কনস্টেবল মোঃ শহীদুল ইসলাম, এসআই রাজ্জাক, এসআই ইলিয়াস, এস আই সুমঙ্গল ও কনস্টেবল মোঃ মিজান, লবনচরা থানার এস আই মোঃ বাবুল আসলাম, এএসআই আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই মনজিল হাসান ও লবনচরা পুলিশ ফাড়ির এসআই মোঃ ওসমান গনি, হরিনটানা থানার এএসআই মোহাম্মদ রিপন মোল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
জেলা পুলিশ সদস্যরা হলেন রূপসা আইচগাতি ফাড়ি ইনচার্জ এসআই জাহিদ, রূপসা থানার এএসআই রবিউল ইসলাম, দাকোপ থানার এএসআই সবুর হোসেন, পাইকগাছা থানার এসআই মমিন, কয়রা থানার এসআই ইকবাল, কয়রা থানার এসআই আকবাল, কয়রা থানার এসআই আজম, ডুমুরিয়া থানার ইনচার্জ এসআই নাহিদ হাসান, ডুমুরিয়া থানার এএসআই রবিউল, বটিয়াঘাটা থানার এসআই শফিকুল ইসলাম (শফিক), দিঘলিয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান, দিঘলিয়া থানার এসআই মধুসুদন, ফুলতলা থানার ওসি আসাদুজ্জামান।
তালিকায় থাকা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী বলেন মনে করেন নগরবাসী। সেই সাথে দোষী পুলিশ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাকর্মিদের আইনের আওতায় এনে কঠর শাস্তির দাবী জানানো হয়েছে।