দুর্নীতি-ইতিহাস ও ‘মুজিব বর্ষ’

0
432

যেদিন মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনও হয়েছিলো এই দিনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তজীবন লাভ করে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে এ দিনেই ফিরে এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। বিভিন্ন কারণেই দিনটিকে বেছে নেয়া হয়েছে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার দিবস হিসেবে। বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এ বছর তার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান। শুধু বাংলাদেশ নয়, ইউনেস্কোর সদস্যভুক্ত ১৯৫টি দেশে একযোগে পালিত হবে এ মুজিববর্ষ। ইউনেস্কোর ৪০তম সাধারণ পরিষদের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ইউনেস্কোভুক্ত দেশগুলোয় মুজিববর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০২০ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্তটি যথার্থই বলতে হবে বলে আমি মনে করি। কারণ একশ’ বছর আগে যে মানুষটির জন্ম হয়েছিল, তারই নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
নতুন প্রজন্মের রাজনীতি শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ ও অর্থনীতির নগণ্য কর্মী হিসেবে মনে করি- হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই সেই ব্যক্তি, যিনি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে আন্দোলন করে গেছেন। এজন্য তাকে সহ্য করতে হয়েছিল জেল-জুলুম, মুখোমুখি হতে হয়েছিল মৃত্যুর। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক নির্মম হত্যাকান্ডে নিহত হন সপরিবারে। এই হত্যাকান্ডের পর সামরিক শাসকদের দীর্ঘ শাসনামলে তাকে উপেক্ষাই শুধু করা হয়নি, চেষ্টা হয়েছিল ইতিহাস বিকৃতির।
এমনও সময় গেছে, যখন বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেই অপচেষ্টায় বিভ্রান্ত হয়েছিলেন কেউ কেউ। তখনকার নতুন প্রজন্ম বঞ্চিত হয়েছিল স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত ইতিহাস জানা থেকে। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। শুরু হয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া। তবে ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যমে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে আবারও শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতির পালা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট আবারও ক্ষমতায় এলে ইতিহাস বিকৃতির ধারা কমলেও ষড়যন্ত্রকারী ও চাটুকারদের কারণে তা বিভিন্নভাবে অব্যহত আছে।
তবে বরাবরই আমি মোমিন মেহেদী বিশ্বাস করি- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে প্রাণ না হারাতেন তবে আজ তাঁর বয়স হতো ৯৮ বছর ৩ মাস ২৪ দিন এবং ২০২০ সালের ১৭ মার্চ তিনি শতায়ু হতেন। ইতিহাস বলে- মুক্তিযুদ্ধের সময় ও স্বাধীনতার পর দিন থেকে মহলবিশেষের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ ছিলো ১৫ আগস্ট। দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি স্বাধীনতার পর যতটা খেপেছিল; জাতীয় চারনীতির ভিত্তিতে সংবিধান রচনা ও নির্বাচিত সরকার গঠিত হওয়া, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে মাইন অপসারণসহ পুনর্বাসন-পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, খাদ্য সংকট সামাল দেয়া আর সবশেষে অন্য সব দেশ বাদ দিয়ে চিকিৎসার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার ফলে একটা কিছু অঘটন ঘটানোর জন্য আরো ক্ষিপ্ত ও উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। এটা ঠিক তখন দুই ধরনের ঘটনা মানুষকে ক্রমাগত হতাশ ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। প্রথমটি হলো নাশকতামূলক কাজ আর দ্বিতীয়টা হলো দুর্নীতি। বেশি কথায় না গিয়ে কেবল চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধুর মস্কো যাওয়ার আগে-পরের ঘটনাগুলো পাশাপাশি রাখলেই তার প্রমাণ মিলবে। বঙ্গবন্ধু বিদেশ যাওয়ার আগেই স্থির হয়েছিল, ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ দুর্নীতিবিরোধী গণপ্রতিরোধ দিবস পালন করবে। শাসক দল তা করছিল বিধায়ই অনুধাবন করা যাবে, দুর্নীতি তখন কোনো সুউচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। আর নাশকতা! ১ মার্চ যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, ১৬ মার্চ গাজী ফজলুর রহমান এমপি আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়। ৯ মার্চ ঢাকার মোহাম্মদপুরে এবং ১৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জের জনতা ব্যাংকে ডাকাতি হয়। ৪ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আলীজান জুটমিলে এবং ৫ মার্চ দৌলতপুরের জুটমিলে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ৪ মার্চ ভেড়ামারায় এবং ১৬ মার্চ পাবনায় নাশকতামূলক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা হয়। পরিস্থিতি এমনই হয় যে, বঙ্গবন্ধুর যাত্রার দিন ১৯ মার্চ আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারী ও সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ সভা ও মিছিল করে। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য, শর্ষেতেই যে ছিল ভূত! বঙ্গবন্ধু সুস্থ হয়ে ফিরে আসার ৪ দিন আগে ব্রাশফায়ারে সূর্য সেন হলের ৭ জন ছাত্র নিহত হয়। এই হত্যাকান্ডের নায়ক ছিল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান। প্রসঙ্গত এই ব্যক্তিটি জিয়া আমলে মুক্তি পায় এবং এখন তার দল আছে বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোটে। যাই হোক, দুর্নীতি ও নাশকতামূলক কাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকলে বঙ্গবন্ধু সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর সরকার সমাজে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দমনের লক্ষ্যে সামরিক বাহিনী নামায়। কল্পনা করা যায়, পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ৮ মে থেকে টানা ৫ দিন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভা এবং ওই সভায় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে দল নির্বিশেষে দুর্নীতিবাজ, চোরাচালানি ও অসাধু ব্যবসায়ী এবং রাতের বাহিনী নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু ওই যে ছিল শর্ষেতে ভূত! উল্লিখিত সভা চলাকালীনই কুমিল্লায় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমকে সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করে এবং তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল করা হয়। দলের ভেতরে প্রচন্ড চাপে তখন তাকে মুক্তি দেয়া হয়। খাদ্য সংকট বিবেচনা করে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ১.৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির চুক্তি সম্পাদন হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, মস্কো যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু খন্দকার মোস্তাককে বাণিজ্যমন্ত্রী নিয়োগ করেন। তখন বাণিজ্য সচিব ছিল পরবর্তী সময়ে জিয়ার মন্ত্রী আব্দুল মোমেন খান। এখানে বলতেই হয় যে, তখনো কিন্তু ১৯৭৪-এর ভয়াবহ বন্যা ও শস্যহানি হয়নি এবং দ্রব্যমূল্য বাড়াকমা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। এই সময় সরকারবিরোধী সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়, যার প্রধান ছিলেন মাওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান খান। এই জোট সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে, তিলকে তাল করে অপপ্রচার তুঙ্গে তোলে। জাতীয় উল্লিখিত সব তৎপরতা বিবেচনায় নিয়েই কেবল দেশ জাতি ও জনগণবিরোধী ষড়যন্ত্র চক্রান্তের সবটা সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও বিবেচনায় নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু মস্কো যাওয়ার আগে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান ইরান ও তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান যান এবং ইসলামি সম্মেলনে যোগ দেন। এ দিকে পাকিস্তান থেকে খবর আসতে থাকে, সেখানে আটকে পড়া বাঙালিদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। মূলত আটকে পড়া মানুষদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য থেকেই বঙ্গবন্ধু চিকিৎসাধীন থাকতেই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের অনুকম্পা প্রদর্শনের বিষয়ে সমঝোতা হয়। ইসলামি সম্মেলন থেকে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর দিনই ২৫ ফেব্রুয়ারি মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ঢাকা সফরে আসেন। পরে জুলাই মাসে আসে মিসরের উপহার ৩০টি ট্রাঙ্ক। এসব ট্রাঙ্ক নামিয়েই সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী এক ক্ষুদ্র অংশ ফারুক-রশীদ-ডালিম চক্র ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে।
ইতিহাসের পাতায় এত অন্ধকারের খেলা আর রাজনৈতিক কালোমানুষদের আস্ফালন দেখে কেবলই আমার মনে হয়- ষাটের দশকের প্রথমদিক থেকে এখন পর্যন্ত রাজনীতিতে কমবেশি জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে মনে প্রশ্ন জাগে, জাসদের মিছিলকে যদি শুরুতেই ভেঙে দেয়া হতো, মমতাজ বেগমকে যদি জেল থেকে না ছেড়ে ‘চোর-চোট্টা-বদমাইশদের’ বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী দিয়ে অভিযান চালিয়ে যাওয়া হতো, মিসরের ট্রাঙ্ক উপহার যদি না নেয়া হতো তবে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কি এ রকম হতো? বঙ্গবন্ধু কি জীবিত থাকতে পারতেন? সেই তো পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি আইন জারি ও এক দল করতেই হয়েছিল।
আজ যখন মুজিব বর্ষের আনন্দর‌্যালী, পটকার আওয়াজ আর ঝলোমলো লাইটে সারাদেশ আনন্দিত; তখন দুর্নীতি পেছন থেকে খামচে ধরেছে নীতি-আদর্শ-সম্ভাবনাকে। তারই সূত্র ধরে রাজধানীর হাতিরঝিলে দেখা মিলেছিলো মানব কুকুরের। হিউম্যান ডগ সেজে হাতিরঝিলের রাস্তায় হেঁটেছেন টুটুল চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। আর সেঁজুতি নামের এক নারী তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সে সময় তাদের কিছু ছবি তোলা হয়। মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। যতদূর জানি- বাংলাদেশে প্রথম হলেও এটি একটি ‘পারফর্মিং আর্ট’। পশ্চিমা ধারণার এই পারফর্মিং আর্ট প্রথম দেখা যায় অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। প্রকাশ্য রাস্তায় ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্যালি এক্সপোর্ট ও পিটার উইবেল এই পারফর্মিং আর্টে অংশ নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেইন্টিং ও ড্রয়িংয়ের শিক্ষার্থী সেঁজুতি এটাকে ‘সমাজতাত্ত্বিক’ ও ‘আচরণমূলক’ কেসস্ট্যাডি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই পারফর্মিং আর্টের উদ্দেশ্য, কার্টুনে যেমন বিভিন্ন প্রাণীকে মানুষের মতো কথা বলা ও আচরণগতভাবে দেখানো হয় তেমনি এখানে মানুষকে প্রাণী চরিত্রে দেখানো হয়েছে। অবশ্য সাহিত্যিক ক্লদিয়ার লেখাকে মতানুসারে- একজন নারী একজন পুরুষকে গলায় রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা আরো ভালো কোনও সামাজিক অবস্থার চিত্র দেখায় না। বরং সমাজ আমাদের ওপর যে সিস্টেম চাপিয়ে দিয়েছে সেটাই ফুটে উঠেছে। এই কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং এই কাজটাকে সাধারণ মানুষ কীভাবে নিয়েছে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা চলেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে ‘ঞধনড়ড়’ অনুষ্ঠান দেখলে হিউম্যান ডগ সম্পর্কে অনেকটা ক্লিয়ার হওয়া যাবে। সেখানকার একটি এপিসোডে ‘হিউম্যান ডগ’ নিয়ে একটি ডকুমেন্টরি আছে, ইউটিউবে পাওয়া যায়। এটি আধুনিক দুনিয়ায় পুরাতন ক্রীতদাস প্রথাও বলা যায়। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে এসব দেখা যায়।
এই কাহিনীটি কেন নিয়ে এসেছি মুজিব বর্ষের লেখায়? প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাই তুলে ধরছি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের দুর্নীতির কিছুকথা- সজিব মিয়া, ২০১৭ সালে কাপাসিয়া টেকনিক্যাল স্কুল থেকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে নবম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে নিবন্ধিত (নম্বর ৮১৭৩৮৮) হয়। কিন্তু এই নিবন্ধন নম্বরে চলতি বছর (২০১৯) এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৪.০৪ পেয়ে যে পাস করেছে সে সবুজ মিয়া নয়। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর নাম রিপন হোসাইন। শুধু পরীক্ষার্থীই নয়, বাবা-মায়ের নামেও পরিবর্তন এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, সবুজ মিয়া কোথায় গেলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটি দুষ্টচক্রের সন্ধান মিলেছে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির শিক্ষকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দুর্নীতির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হলে একজনকে ছাত্র বানিয়ে দিচ্ছে। আবার পরীক্ষায় অংশ না নিলেও পাস করিয়ে দিচ্ছে যে কাউকে। মোটা অঙ্কের টাকা গুনলেই এভাবে পাস ও সনদ মেলে বলে জানা গেছে। ২০১৯ সালের এসএসসি ভোকেশনালে কেবল উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানেই এমন অনেক শিক্ষার্থীর সন্ধান মিলেছে। এ চক্রটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের বিভিন্ন সেমিস্টারে ফেল করা ৫৭৪ শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন না করিয়ে নম্বর দিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে। এমনকি মাঝপথে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জায়গায় নতুন ছাত্রছাত্রীদের নাম ঢুকিয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে দিচ্ছে। এসএসসি, এইচএসসি এবং ডিপ্লোমায় খারাপ পরীক্ষা দেয়া শিক্ষার্থীদেরও পাস করানোর ব্যবস্থা রেখেছে সিন্ডিকেট। এ ধরনের ছাত্রছাত্রীরা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তখন শিক্ষক নামে দালালরা ছাত্রছাত্রীদের কাছে থেকে বিষয় প্রতি মোটা অঙ্কের অর্থ নেয়। এর বিনিময়ে তাদের পাস করানোর দায়িত্ব নিয়ে থাকে ওই সব শিক্ষক।
সরাসরি এসএসসি (ভোক ও দাখিল) এবং এইচএসসি (বিএম) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিয়ে দেয়ার মূল ব্যবসাটি করে থাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। এই কাজে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। আর সরাসরি ডিপ্লোমা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য প্রতি ছাত্রছাত্রীর কাছে থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকা করে নেন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নামের দালালরা। আর বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পান ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়েও একটা বাণিজ্য আছে। নবম শ্রেণিতে অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রেজিস্ট্রেশনের সময় সব সিট ফিলাপ করে রাখে। ফাইনাল পরীক্ষার আগ মুহূর্তে অনেক ছাত্রছাত্রী সরাসরি (নবমের) ফাইনাল পরীক্ষা দিতে আসে। এ ধরনের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ১০-১২ হাজার টাকা নিয়ে নাম রিপ্লেস করা হয়। তখন এ ধরনের ছাত্রছাত্রীরা সরাসরি নবমের ফাইনাল অংশ করে।
এমন পরিস্থিতি কিন্তু দেশের প্রতিটি সেক্টরে। আর এমন অবস্থার ভেতরেও যদি দুর্নীতিকে প্রতিরোধ না করে চলতেই থাকে মুজিব বর্ষের আনন্দখেলা; তাহলে অপমান করা হবে বিশ্বসেরা রাজনীতিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে-স্বপ্নকে। যা অন্তত আমি চাই না-নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা চায় না। চাই না বলেই কথা বলছি-কলাম লিখছি। আশা করি গঠনমূলক এই সমালোচনার যথাযথ গবেষণা হবে এবং বংলাদেশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার স্মরণে ‘মুজিব বর্ষ’ পালিত হবে দুর্নীতি-অন্যায় আর হতাশার দীর্ঘশ্বাসমুক্তভাবে…

মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি