দাকোপে রাস্তার কাজে অবৈধভাবে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন

0
781
smart

আজিজুর রহমান, দাকোপ থেকে ফিরে :
খুলনার দাকোপ উপজেলার বুড়িরডাবুর মডেল স্কুল থেকে কালিকাবাটি গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা উঁচু করাসহ পিচ ঢালা নির্মাণকাজ চলছে। লাউডোব ইউনিয়নের বুড়িরডাবুর খাল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়সহ খালের দুইপাড় ভাঙনের আশঙ্কা করছে এলাকাবাসি। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, আইনগতভাবে খালের কোনো অংশ থেকে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীনদলের ছত্রছায়ায় স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে দাকোপের বিভিন্ন নদী ও খাল থেকে বালুমহল ইজারা ছাড়ায় বালু উত্তোলন করছে ড্রেজার মালিকরা। তবে উপজেলায় কোন বালু মহল না থাকলেও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছে মহলটি। উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্বেও কোনোভাবেই স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না নদ-নদী ও খাল থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন।

গতকাল শুক্রবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বুড়িরডাবুর খালে ভাসছে দুইটি পাটাতন (বোর্ড)। কয়েকটি তেলের ড্রামের ওপর তক্তা বিছিয়ে বাঁশের সঙ্গে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয়েছে পাটাতন। ভাসমান পাটাতনটি সুবিধামতো খালের বিভিন্ন স্থানে সরানো হচ্ছে। দুটি বালু তোলার যন্ত্র (ডিজেলচালিত অগভীর নলকূপের মোটর) রয়েছে পাটাতনের ওপর। একটি যন্ত্র থেকে পাইপ খালে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই পাইপ দিয়ে খাল থেকে বালু কেটে ওপরে তোলা হচ্ছে এবং অপর যন্ত্রটি পানির সঙ্গে সেই বালু প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে সামনে ঠেলে দিচ্ছে। প্রায় ১২০ গজ দূরে বালু গিয়ে পড়ছে ওই রাস্তা নির্মাণকাজের পাশে। বালু পড়ে উঁচু হচ্ছে ওই জায়গা। কয়েকজন শ্রমিক বালু ছড়িয়ে জায়গা সমান করছেন। তবে রাস্তা নির্মাণকাজের কোনো সাইনবোর্ড কোথাও চোখে পড়েনি।

বালুমহল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ অমান্য করে অপরিকল্পিতভাবে দাকোপের নদী ও খাল থেকে ড্রেজারযন্ত্রের সাহায্যে বালু উত্তোলন করে রাস্তা নির্মাণ, পুকুর ও বাড়ী ভরাট কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বুড়িরডাবুর থেকে কালিকাবাটি গ্রাম পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তার নির্মাণকাজ করছেন খুলনার ‘মেসার্স এ সামাদ ট্রেডার্স’ নামের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই রাস্তায় বালু দিয়ে ভরাট করার জন্য বালুর ঠিকাদার নিয়োগ করে।

বালু তোলার কাজে ব্যবহৃত স্যালো ড্রেজারের মালিক আব্দুল আজিজ হাওলাদার। তিনি খুলনাটাইমসকে বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের অনুমতিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। মাসখানেক ধরে বুড়িরডাবুর খাল থেকে দুটি ড্রেজারের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ বালু তুলে রাস্তার কাজে দেওয়া হচ্ছে। তিন টাকা ফুট দরে বালু তুলছি। এখন খাল থেকে বালু তেমন উঠছে না। বালু তোলার জায়গায় খাল সাত থেকে আট ফুট গভীর হয়েছে। খালের পাড় যাতে না ভাঙে সে জন্য আমরা খালের মাঝ থেকে ১ হাজার ২০০ ফুট করে বালু কাটছি। কাজ প্রায় শেষের পথে। তবে এ কাজের জন্য প্রশাসনের কোনো অনুমতিপত্র নেই বলে জানান তিনি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী অহিদুজ্জামান বাবু মুঠোফোনে খুলনাটাইমসকে বলেন, নির্মাণকাজের জন্য যে পরিমাণ টাকা ধরা হয়েছে তাতে কাজ সম্পন্ন করা খুবই কষ্টসাধ্য। তাই স্থানীয় খাল থেকে বালু তুলে রাস্তার নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে কাজ করলে এলাকার কোনো ক্ষতি হবে না দাবি করে তিনি জানান, সব জায়গায় এমন পদ্ধতিতে বালু তুলে নির্মাণকাজ চলছে। তবে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করে ঠিকাদার বলেন, কাজ প্রায় শেষের পথে, দুদিন বাদে কাজটি শেষ করা হবে। আমি ড্রেজার মালিককে বালু তুলতে নিষেধ করে দিচ্ছি।

স্থানীয় রাকিব হোসেন নামের একজন বাসিন্দা জানান, এভাবে বালু উত্তোলন করলে ভূগর্ভের শূন্যস্থান যখন পার্শ্বের বালু এবং মাটি পূরণ করতে যাবে, তখন ভূমি ধ্বসের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে এলাকায় বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলেন, এ বালু ব্যবসার সাথে সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতাদের হাত রয়েছে তাই প্রশাসন বললেও তারা শোনে না। সাধারণ মানুষও ভয়ে মুখ খুলতে পারে না। তারা আরও বলেন, নদীভাঙ্গন এ উপজেলার প্রধান সমস্যা এবং সে সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন। অথচ এলাকার কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে নদীভাঙ্গন আরও প্রসারিত হচ্ছে।

স্থানীয় ওই খাল থেকে বালু উত্তোলনের নেপথ্যে লাউডোব ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান সরোজিৎ কুমার রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে চেয়ারম্যান খুলনাটাইমসকে বলেন, খালের বালু দিয়ে বুড়িরডাবুর রাস্তা নির্মাণকাজ হলেও বালু তোলার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। উপজেলা প্রশাসন খাল থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করেছিল। তারপর থেকে ইউপির রাস্তার নির্মাণকাজ বহুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। তবে ড্রেজার মালিক যদি বালু উত্তোলন করে থাকে, তাহলে সেটি সে ব্যক্তিগতভাবে করছে। পরিবেশের ক্ষতি হোক আর নাই হোক, খাল থেকে আমি কোনোভাবে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে পারিনা।

দাকোপ উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) তারিফ-উল-হাসান মুঠোফোনে বলেন, বিষয়টি শোনান সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকার তফসিলদারকে ঘটনাস্থলে গিয়ে ড্রেজারটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এছাড়া এর সঙ্গে জড়িত সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। স্থায়ীভাবে বন্ধের বিষয় জানতে চাইলে বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় অনেক সময় ঘটনাস্থলে পৌছানো যায় না। নদী বা খাল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হয়েছে। তবে উপকূলীয় এ অঞ্চলে বালু উত্তোলন আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনা-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী খুলনাটাইমসকে জানান, মাটি ও বালু ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুসারে একক কোনো প্রতিষ্ঠান নদী বা খাল থেকে এক কণাও বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে পারবে না। তা ছাড়া, দাকোপ উপজেলায় কোনো বালুমহাল নেই। কেউ যদি বুড়িরডাবুর খাল থেকে বালু উত্তোলন করে থাকে, তাহলে সেটি সম্পন্ন অবৈধভাবে উত্তোলন করছে।