দাকোপে জয়ীর আত্মহত্যা; দু‘বছরেও চোখের পানি শুকায়নি

0
1325

আজিজুর রহমান, খুলনাটাইমস :
বছর দুয়েক আগের কথা। সরকারি এলবিকে ডিগ্রী মহিলা মহাবিদ্যালয়ের এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী জয়ী মণ্ডল(১৭) আত্মহত্যা করেন নিজের কলেজ হোস্টেলকক্ষে। সেই দিনটি ছিল ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর। দিনটি আসলে মৃত জয়ীর মা-বাবা চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারে না। তার শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো পরিবারের সদস্যের মাঝে।

খুব ভোরে জয়ীর বাড়িতে গেলে দু‘চালা খড়ের তৈরি ঘরের দরজায় মুখে হাত লাগিয়ে বসে ছিল মৃত জয়ীর মা অনিমা মণ্ডল। মুখের দিকে তাকালে মনে হয় জয়ীকে নিয়েই তার ভাবনা। অশ্রু ভেজা ছিল দুটি চোখ। এ যেনো দুটি বছর কাটলেও শুকায়নি তাঁর চোখের পানি। কথা বলার শুরুতেই বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। মুখের ভাষায় কিছু না বলে হাউ-মাউ করে কেঁদে পাশ কাটিয়ে চলে জান মেয়ের সমাধীর পাশে।

বুধবার (৬ নভেম্বর) মেধাবী শিক্ষার্থী জয়ী মণ্ডলের দ্বিতীয় মৃতবার্ষিকী ছিল। তার স্বজনরা শোকের মধ্যদিয়ে তাকে স্মরণ করেন। কিন্তু স্বজন হারানোর কষ্ট আজও কেউ ভুলতে পারেনি শোকাহত পরিবারটি। তবে পারিবারিকভাবে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে গেলবারের ন্যায় এ বছরও মৃতবার্ষিকী পালন করা হয়। সমাধীর চারপাশ পরিষ্কার করে সুগদ্ধে ভরে রাখেন। সকালে প্রদীপ জ্বালিয়ে স্মরণ করা হয়। আর সারাদিন চলে তার আত্মার শান্তির জন্য গীতাপাঠ ও ধর্মীয় আলোচনা। নাম ছিল তার জয়ী। তাই জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েই এগিয়ে চলার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু বখাটেরা তাকে জয়ী হতে দেয়নি! উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরপর আত্মহননের পথ বেচে নেয় সে।

মৃত জয়ীর বাবা কুমারেশ মণ্ডল মেয়ের আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীর শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। সেটি আজ আমাদের জন্য প্রযোজ্য। আইনের কাছেও আজ বড় অসহায়। মামলার আসামী প্রভাবশালী হওয়ায় আইনও পারছে না তাকে ধরতে। তিনি বলেন, ঘটনার পরে কত না আন্দোলন হয়েছিল আরও কত কি? গেল তো সবকিছুই হারিয়ে। মেয়েটি আমার বড্ড শান্ত ছিল, তা হইতো শান্তভাবে তার মৃত্যু হয়েছে। গলায় ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করলেও হোস্টেলকক্ষের কোনো কিছুই এলোমেলো হয়নি। এতটাই শান্তভাবে মৃত্যুটি হয়েছিল।

কুমারেশ বলেন, মেয়েটি মেধাবী হওয়ায় তার ইচ্ছে ছিল ভাল কিছু করে দেখানোর। তবে বেঁচে থেকে তো আর ভাল কিছু করে দেখাতে পারল না। মরে গিয়ে অনেক ভাল কিছু দেখিয়েছে। তার মৃত্যু নিয়ে সব জায়গাতেই একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। দুটি বছর কেটে গেল, তাতে কি হল! বিচার তো চলছে, আসামীও বহাল তবিয়তে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। তিনি কাঁদেন আর বলেন, তবে আমার মেয়ের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে। এমনভাবে আর যেনো কোনো মেয়েকে মরতে না হয় সেদিকে দেখতে হবে। মৃত জয়ীর বাবা আরও বলেন, মেয়েটি বাড়িতে আসলে আমার সঙ্গে কত না স্বপ্নের কথা বলত। বড় হয়ে আমাদের সকলের দেখাশোার ভর সেই নেবে বলে কত যে আশা ছিল তার বুকে। আজ মনের আশাগুলো বুকে নিয়ে পথের ধারে শুইয়ে আছে কত না শান্তিতে! তার সামাধীস্থল দেখে দুটি বছর যে কি কষ্টে পার করছি তা বলে বোঝানো যাবে না। যার চলে যায় সেই বোঝে বেদনার কত যন্ত্রণা?

উল্লেখ্য, বাজুয়া এসএন ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ইনজামাম মির্জার হাতে লঞ্চিত হয়ে রাতে নিজের কলেজ হোস্টেলকক্ষে আত্মহত্যা করেন কলেজ ছাত্রী জয়ী ম-ল। ঘটনাটি ছড়িয়ে গেলে কলেজ ছাত্রলীগের দলীয় পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অপরাধে দাকোপ উপজেলার উত্তর বানীশান্তা গ্রামের বাসিন্দা মৃত জয়ীর বাবা বাদী হয়ে বাজুয়া গ্রামের মৃত নজরুল মির্জার ছেলে ইনজামাম মির্জার নাম উল্লেখ করে আরও তিন থেকে চারজনকে আসামী করে দাকোপ থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহার বরাত দিয়ে, জয়ী কলেজ হোস্টেলে থাকা কালীনে স্থানীয় অরিন্দম নামের এক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তেন। প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে ইনজামাম প্রায় সময় তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু জয়ী তাতে সাড়া না দিলে ইনজামাম তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। এমন কি আত্মহত্যা করার মত কথাও বলেন তিনি। ঘটনার একদিন আগে জয়ীকে একটি পরিত্যক্ত ঘরে আটক করে রাখে ইমজামাম ও তার সহযোগিরা। পরে সেখান থেকে হোস্টেলকক্ষে এসেই রাতে গলায় ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করে। এরপর সকালে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।

মামলাটি আত্মহত্যার প্ররোচনার অপরাধে নথিভূক্ত হলে তদন্ত করে সঠিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করার জন্য আদেশ দেন আদালত। সেই অনুযায়ী দাকোপ থানা পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তের সময় একাধিকবার তদন্তকারী কর্মকর্তার পরিবর্তন হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৮ জুন মাসে মামলাটির চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে আদালতে দায়ের করা হয়। সে সময় মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা ছিলেন তৎকালীন দাকোপ থানার উপপরিদর্শক কাজী নাজমুস সাকিব।

তদন্ত প্রতিবেদন সুত্রমতে, জয়ীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় ইনজামাম মির্জা। তাতে সাড়া না দেয়ায় প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে বাজুয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে জয়ীকে নিয়ে আশোভন আচারণ ও মারধর করে থাকে ইনজামাম। এমন ধরণের অপমান সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন কলেজ শিক্ষার্থী জয়ী মণ্ডল।

মৃত জয়ীর পক্ষের আইনজীবি জিএম কামরুজ্জামান বলেন, বাদীপক্ষ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ায় আসামীপক্ষ পার পেয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসের আগামী ১৮ তারিখে মামলার সাক্ষ্যদের জবানবন্দী নেবেন জেলা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদাতলের হাকিম আশিকুজ্জামান। কিন্তু স্বাক্ষীরা আদালতে জবানবন্দী দিতে না রাজ প্রকাশ করছে। কারণ আসামী প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন সময় তাদেরকে হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে ইনজামাম আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্ত আছে। তবে আদালতে স্বাক্ষীরা সঠিক সাক্ষ্য দিতে পারলে আসামীর সর্বোচ্চ শান্তি পাবেন বলে আশা করা যায়।