চালু হওয়ার পর থেকেই বিকল ঢাকা ওয়াসার দুটি পাম্পিং স্টেশন

0
486

খুলনাটাইমস এক্সক্লুসিভ: ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বিপুল টাকায় নির্মিত দুটি পাম্পিং স্টেশন চালুর হওয়ার পর থেকেই বিকল হয়ে আছে। আধুনিক প্রযুক্তির ওই স্টেশনে নি¤œমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অথচ দুটি স্টেশন নির্মাণে ব্য হয়েছে ২২০ কোটি টাকা। াকন্তু বিপুল টাকায় নির্মিত ওই পাম্প স্টেশনগুলো প্রয়োজনের সময় কোনো কাজেই আসছে না। ওই দুটি পাম্প স্টেশনের একটি রামপুরায়, আরেকটি কমলাপুরে। কমলাপুরের স্টেশনটি বিকল্প উপায়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চালানো হচ্ছে। আর বিগত ২০১৬ সালে রামপুরার স্টেশনটি কেবল কয়েক দিনের জন্য চালু হয়েছিল। তাছাড়া সেটা আর ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। রামপুরার পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে ২৫ হাজার লিটার পানি নিস্কাশনের কথা। আর কমলাপুর স্টেশনের মাধ্যমে ১৫ হাজার লিটার। চলতি বর্ষা মৌসুমে ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের লোকজন রামপুরা স্টেশনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, সেটির একটি যন্ত্র নষ্ট। মেরামতের জন্য ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আনার কাজ চলছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বশীল কেউ কথা বলতে রাজি নন। ঢাকা ওয়াসা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১২ সালে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে রামপুরা ব্রিজের পাশে ও কমলাপুর স্টেডিয়ামের পাশে দুটি আধুনিক পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ঢাকা ওয়াসা। রামপুরার পাম্পের মাধ্যমে হাতিরঝিলের পানি পাম্পিং করে রামপুরা খালে ফেলা হবে ও কমলাপুর পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে সেগুনবাগিচা, ফকিরাপুল, মালিবাগ, কাকরাইল, মতিঝিলসহ আশপাশের পানি নিস্কাশন করা হবে। কারণ বর্ষা মৌসুমে রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের পানির স্তর রাজধানীর পানির স্তরের চেয়ে উঁচু হয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে রাজধানীর পানি বাইরে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। সেজন্য অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। ঢাকা ওয়াসার তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল আজিজের তত্ত¡াবধানেই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। তখন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহŸান করা হয়। কাজ পায় চীনা প্রতিষ্ঠান সিএএমসি। কিন্তু শুরু থেকেই প্রকল্পে নি¤œমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভিযোগ উঠতে থাকে। ২০১৪ সালে পাম্পিং স্টেশনের কাজ সম্পন্ন হয়। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ওয়ারেন্টি পিরিয়ড হিসেবে দুই বছর নির্মাণকারী পাম্প দুটির তত্ত¡াবধান করবে। পরে তারা ওয়াসার কাছে সম্পূর্ণ ন্যস্ত করবে। তারপর তাদের কোনো দায় থাকবে না। তবে এ সময়ে পাম্প দুটি পরিচালনার জন্য ঢাকা ওয়াসার একটি টিমকে দক্ষ হিসেবেও গড়ে দিয়ে যাবে। কিন্তু তারা ঢাকা ওয়াসার কাউকেই সেভাবে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। আর যে সময়ে সিএএমসি তত্ত¡াবধানের দায়িত্বে ছিল, ওই সময়েও পাম্প দুটি কোনো কাজে আসেনি। ওয়াসার হাতে ন্যস্ত করার সময় ২০১৬ সালে রামপুরা পাম্পটি কয়েক দিনের জন্য চালু করা হয়েছিল। পরে আর চালু করা সম্ভব হয়নি। আর কমলাপুরের পাম্পটি অচল থাকার কারণে পরে ওয়াসা বাধ্য হয়ে পাশেই পুরনো দমকল পদ্ধতিতে ফিরে যায়। সেখানে ওই পদ্ধতিতে পাম্পিংয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। আর মাঝে মাঝেই একেকটি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন মেরামতের জন্য ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। সূত্র জানায়, রামপুরা পাম্পিং স্টেশনটি তৈরির জন্য রামপুরা ব্রিজের পাশে একটি ¯øুইসগেট তৈরি করা হয়েছে। গেট দিয়ে সেই পানি পাম্পিং স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত একটি ওয়াটার পন্ডে জমা হয়। সেই পানি নিস্কাশনের জন্য মূল স্টেশনে রয়েছে তিনতলার একটি অবকাঠামো। মূল মেশিনারিগুলো তৃতীয় তলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। আর নিচতলায় রয়েছে পাঁচটি পাম্পের সেটআপ। একইভাবে কমলাপুর পাম্পিং স্টেশনে রয়েছে তিনটি পাম্পের সেটআপ। একেকটি পাম্প প্রতি সেকেন্ডে ৫ হাজার লিটার পানি নিস্কাশনের ক্ষমতা থাকার কথা। কিন্তু সেগুলো কোনো পানিই নিস্কাশন করতে পারছে না। সূত্র আরো জানায়, পাম্প স্টেশন নির্মাণের ক্ষেত্রে শুরুতেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। দুটি পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহŸানের পর ৬টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। তার মধ্যে সর্বনি¤œ দরদাতা হয় চীনা কোম্পানি সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি এজেন্ট ছিল সাকো ইন্টারন্যাশনাল। আর দ্বিতীয় সর্বনি¤œ দরদাতা হয় কোরিয়ান কোম্পানি হাইওয়াং ইবারা। ওই সময় ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়, সাকো ইন্টারন্যাশনালকে কাজ দিলে বিশ্বব্যাংক অখুশি হতে পারে। এ জন্য লোকাল এজেন্ট পরিবর্তন করতে হবে। তখন আজিজুল আকিল ডেভিড নামের এক ব্যক্তি সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের বাংলাদেশি এজেন্ট হন। মূলত আজিজুল আকিল ডেভিডই পরে পাম্প দুটি নির্মাণ করেন। এ ঘটনায় সাকো ইন্টারন্যাশনাল ওয়াসায় অভিযোগও দায়ের করে। ওয়াসা তা আমলে নেয়নি। পাম্প দুটি নির্মাণের পর থেকেই ঠিকমতো চলছে না। এর ফলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকার বাসিন্দারা জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পড়ছেন। তবে সিএএমসির বাংলাদেশের এজেন্ট আজিজুল আকিল ডেভিডের মতে, দুই বছর ওয়ারেন্টি পিরিয়ড ছিল। ওই সময়ের মধ্যে ওয়াসার সঙ্গে যতো ধরনের চুক্তি ছিল, সবকিছু পূর্ণ করা হয়েছে। তখন ওয়াসা কোনো অভিযোগ করেনি। এখন যদি কেউ বলে নি¤œমানের জিনিসপত্র দেয়া হয়েছে, সে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি পাম্প চালানোর জন্য ওয়াসার লোকদের বিদেশে নিয়ে ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কেউ যদি ঠিকমতো প্রশিক্ষণ না নেয়, তাহলে সেটা প্রশিক্ষাণার্থীর দায়, প্রশিক্ষকের নয়। এদিকে ঢাকা ওয়াসা প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক জানান, ‘ঢাকা ওয়াসা সাভারের ভাকুর্তাতে একটা প্রকল্প করেছে, সেখানে নাকি পানির খনির আছে। অথচ এখন তারা পানি পাচ্ছে না সেখানে। সেখানেও অনেক টাকা খরচ করেছে তারা। এগুলো বলতে গেলে তারা বলে, তাদের পেছনে লেগেছি। আর ওয়াসার দায়িত্বশীলদের সঙ্গে তো কথা বলাই মুশকিল। এ জন্য ওয়াসা নিয়ে কথাও বলতে চাই না। অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দুটি পাম্পিং স্টেশনের এমন অবস্থার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে রামপুরা পাম্প স্টেশনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম জানান, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমাকে এটা দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে এটা কখনও চলেনি। স¤প্রতি একটি জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা মেরামতের জন্য যে ধরনের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী প্রয়োজন, সেটা বাংলাদেশে নেই। সিঙ্গাপুর ও ভারতে আছে। ভারত থেকে সেই বিশেষজ্ঞকে আনার জন্য পাম্প স্টেশন স্থাপনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, ২২ লাখ টাকা খরচ হবে। এখন তাকে আনার কাজ চলছে। তাছাড়া এই পাম্পটি চালানোর কৌশল শেখার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমাকে চীনে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো কিছু শেখায়নি। ১০ দিন ঘুরেফিরে চলে আসি। ফলে আমিও আসলে জানি না কোনো সমস্যা হলে কী করতে হবে। কাজেই বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে দমকল পদ্ধতিতে পাম্পিং করতে বিদ্যুতের খরচ বেশি হয় বিধায় তখন এ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সব সময় ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার নিচে এই পাম্পের মেশিনারিগুলো রাখতে হয়। এ জন্য মেশিন রুমে ২০-২৫টা এসি লাগানো আছে। এ জন্য মাসে বিদ্যুতের বিল ওঠে তিন লাখ টাকা।