খুলনায় বাস মালিক সমিতির অন্তর্কোন্দল চরমে : বন্ধ চার রুট

0
1109

কে এইচ মনি:
খুলনা জেলা বাস মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির আওতাধীন মোংলা রুটে যাত্রীবাহি বাস আটকিয়ে বাসের চালক ও হেলপারকে মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। মঙ্গলবার রূপসা-বাগেরহাট বাস, মিনিবাস, কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির কর্মকর্তাদের নির্দেশে এ ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিবাদে সকালে খুলনা জেলা বাস মিনিবাস ও খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের যৌথ জরুরি সভায় বাগেরহাট, পিরোজপুর, মোংলা ও চিতলমারী রুটে বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে।
রূপসা-বাগেরহাট বাস, মিনিবাস, কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সভাপতি এস এম মোস্তফা রশিদী রেজা মঙ্গলবার দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে সোনাডাঙ্গা-মোংলা রুটে অনৈতিকভাবে জোরপূর্বক খুলনা জেলা বাস মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতি সোনাডাঙ্গা থেকে তাদের গাড়ির সংখ্যার অধিক গাড়ি, সিরিয়াল ছাড়া গাড়ি ছাড়া শুরু করলে উক্ত রুটে গাড়ির মালিকরা তার প্রতিবাদ করেন। এর কারণে জেলা বাস মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতি অনৈতিক সিদ্ধান্ত ও জোরপূর্বক সোনাডাঙ্গা, মোংলা, বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ তাদের সমিতির আওতাধীন খুলনা হতে পূর্ব দক্ষিণ এবং পূর্ব উত্তরের সকল রুটের গাড়ি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, গত ২০০৮ সালে খুলনা সড়ক পরিবহণ মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহবানে যৌথ সভায় সকল সমিতির আলাদা করে সিদ্ধান্তের বিষয়ে ওই মালিক সমিতি উপেক্ষা করেছে। সংবাদ সম্মেলনে কুদির বটতলা মোংলা রুটে বাস আটকিয়ে চালককে মারধর ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কোন বাসের মালিক যদি ক্ষুব্ধ হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকে তাহলে এর জন্য আমরা দায়ি না। তাদের সমিতির আওতাধীন বিভিন্ন রুটে গাড়ি চলাচলে চাঁদাবাজি ও অনিয়মসহ সার্বিক বিষয় অস্বীকার করে বলেন, এগুলো সত্য না।
খুলনা জেলা বাস মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০০৭ সালে তৎকালীন বিভাগীয় সমিতির কর্মকর্তা এবং রূপসা বাগেরহাট সমিতির কর্মকর্তাদের মাঝে আলোচনার ফলশ্রুতিতে খুলনা সমিতির ১টি গাড়ি এবং তাদের সমিতির ৯টি গাড়ি চলাচল করার সিদ্ধান্ত ছিল। এই সিদ্ধান্ত প্রায় ১১/১২ বছর অতিবাহিত হয়ে আসছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দাবি ছিল ওই রুটে এবার থেকে সমান সমান গাড়ি রুটে চলাচল করবে। এ বিষয়ে জেলা বাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকেও তাদের চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার তাদের সমিতির আওতাধীন খুলনা থেকে মোংলা রুটে একটি যাত্রীবাহি বাস সকালে মোংলার উদ্দেশ্যে ট্রিপে ছেড়ে যায়। ওই বাসটি রূপসা কুদির বটতলা নামক স্থানে পৌঁছালে রূপসা-বাগেরহাট বাস মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির লোকজন বাসের যাত্রীদের জোর করে নামিয়ে দেয়। গাড়ি আটকিয়ে রেখে বাসের চালক ও হেলপারকে মারধর করে টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে খুলনা জেলা বাস মিনিবাস ও খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের যৌথ জরুরি সভায় উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাগেরহাট, পিরোজপুর, মোংলা ও চিতরমালী রুটে বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই যৌথ সভা সমিতির সহ-সভাপতি এনায়েত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
খুলনা জেলা বাস মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির যুগ্ম আহবায়ক মোঃ আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে রূপসা-বাগেরহাট বাস মালিক সমিতিকে মোংলা রুটে গাড়ি সমান সমান চলাচলের আহবান জানিয়েছি। সেই মোতাবেক আমরা ৩০ জানুয়ারি সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে মোংলার উদ্দেশ্যে একটি যাত্রীবাহি বাস ছেড়ে যায়। তারা কুদির বটতলা নামক স্থানে বাসটিকে আটকিয়ে রেখে গাড়ির চালক ও হেলপারকে মারধর করেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে টাকাও ছিনিয়ে নেয়। এ বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধান ও আমাদের গাড়ির চালককে মারধর করার বিষয়টি যতক্ষণ পর্যন্ত সুরাহা না হচ্ছে, ততদিন ওই রুটে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে।
মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাকির হোসেন বিপ্লব বলেন, এই ঘটনায় বিকেলে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ মিজানুর রহমান মিজান এর হস্তক্ষেপে উভয় পক্ষ আলোচনা সভায় ৪টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ স্থগিত করা হয়েছে।
রূপসা-বাগেরহাট বাস, মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস সমিতির আওতাধীন বাস মালিক ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রভাব খাটিয়ে ১৪টি গাড়ি অবৈধভাবে কোন সিরিয়াল ছাড়াই মোংলা ডাইরেক্ট রুটে প্রতিদিন চলাচল করছে। এর বাইরে সমিতির নিয়মনীতি ছাড়াই মাত্রাতিরিক্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। রূপসা উপজেলার কুদির বটতলায় বিআরটিসি গাড়ি থেকে ৩শ’ টাকা ও যে কোন পরিবহণগুলো থেকে প্রতিদিন ২শ’ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
জানা গেছে, রূপসা-বাগেরহাট বাস, মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতি-রেজিঃ নং খুঃ ৪৩৭। এই সমিতির আওতাধীন ১৮টি রুটে বাস চলাচল থাকলেও ইতোমধ্যে ২টি রুট বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে রূপসা-বাগেরহাট, রূপসা-মোংলা, রূপসা-মোল্লাহাট, রূপসা-ভা-ারকোট, রূপসা-রামপাল, রূপসা-গিলাতলা, রূপসা-মোংলা (লোকাল), রূপসা-বাগেরহাট (লোকাল), সোনাডাঙ্গা-বাগেরহাট, সোনাডাঙ্গা-পিরোজপুর, সোনাডাঙ্গা-মোংলা (গেটলক), পশ্চিম রূপসা-বরিশাল, সোনাডাঙ্গা-টেকেরহাট ও মাদারীপুর, মোংলা-বাগেরহাট। এছাড়া রূপসা-শেয়ালী ও রূপসা-পুরাতন রোডের রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এই সমিতির আওতাধীন ৪শ’র মতো গাড়ি ছিল। বিভিন্ন রুটে অবৈধভাবে সিরিয়াল দেওয়ার কারণে অনেক পরিবহণ মালিক লোকসানের মুখে পড়ে এ ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে যান। এছাড়া মালিক সমিতির নিয়মিত গাড়ি বাদেও বিভিন্ন রুটে অবৈধভাবে সিরিয়ালের নামে টাকা আদায় করছেন। সোনাডাঙ্গা ও রূপসা থেকে মোংলার ডাইরেক্ট গাড়ি সমিতির নিয়মতান্ত্রিক গাড়ির সিরিয়াল ছাড়াও অবৈধভাবে ১২টি গাড়ি পরিচালনা করা হচ্ছে। এই সব গাড়িতে সোনাডাঙ্গা থেকে দেড় হাজার টাকা ও রূপসায় দেড় হাজার মোট ৩ হাজার টাকা প্রতিদিন ওই সমিতিকে দিতে হয়। অর্থাৎ ওই সব প্রতিটি গাড়িতে মাসিক চুক্তি হিসেবে বাস মালিকরা ৪৫ হাজার টাকা ওই সমিতিকে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরিবহণ মালিক জানান, সোনাডাঙ্গা থেকে মোংলার উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়লে সিরিয়াল অনুযায়ী সমিতিকে দিতে হচ্ছে ৩৫০ টাকা এবং মোংলা মাথায় গিয়ে আরও দিতে হচ্ছে ১২০ টাকা। এর বাইরেও পথে ৪টি পয়েন্টেও বাস মালিকদের আরও ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। এই রুটে রূপসা-মোংলা (গেটলক) বতর্মানে সিরিয়াল অনুযায়ী ৫৯টির মতো গাড়ি চলাচল করছে। আর রূপসা-মোংলা (লোকাল) ৪৩টি গাড়ি রয়েছে। রূপসা-মোল্লাহাটে চলে ৬৪টি গাড়ি। এই সব গাড়িগুলো সিরিয়াল মোতাবেক ওই সব রুটে চলাচল করে। কিন্তু সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সমিতির অন্তর্ভুক্ত বাস মালিকের প্রতিটি গাড়িতে সিরিয়াল অনুযায়ী ৫০ টাকা নেয়ার ধার্য থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। এছাড়া রূপসা-বাগেরহাট মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন গাড়ি প্রতি ২০ টাকা চাঁদা নেওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে গাড়ি প্রতি ৪০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছেন। এই ৩০০-৪০০ গাড়ি থেকে এই চাঁদা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রংপুর গাড়ি রূপসা রুট থেকে গেলে ওই মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন অবৈধভাবে প্রতি গাড়ি থেকেও ১০০-১৫০ টাকা করে উত্তোলন করে। এছাড়া ওই মালিক সমিতির বর্তমান জয়েন্ট সেক্রেটারি মোঃ ফরিদ শেখ এর নিজের মোংলা লোকাল রুটে ৪টি গাড়ি চলাচল করছে। এ সব গাড়িতে কোন সিরিয়ালের টাকাও দেওয়া লাগে না। এছাড়া কয়েকটি পয়েন্টেও বাস মালিকদের চাঁদা দিতে হয়। এই সব অনিয়মের বিরুদ্ধে পরিবহণ মালিকরা প্রতিবাদ করলে তাদের গাড়ি সিরিয়াল অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেন।
—