কয়রায় দুর্যোগ বন্যা নিত্য সঙ্গী, ভেসে যাক সকল অমানবিকতা 

0
589

ওবায়দুল কবির সম্রাট:কয়রা:- ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বন্যা, দুর্যোগ বাংলাদেশের প্রতি বছরের ঘটনা।আর সব সময়  দুর্যোগের ও বন্যায় সাথে লড়াই করে বাঁঁচতে হয় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের। বেশি আতঙ্কে থাকতে হয় ঝুঁকিপূর্ণ বেঁড়িবাধের জন্য।মাঝে মাঝে সেই দুর্যোগ,  বন্যা বেঁধিবাধ ভেঙ্গে  প্রলয়ঙ্কারী হয়ে ভাসিয়ে নেয় – জীবন, ফসল, সম্পদ, ঘরবাড়ি, গবাদি পশু; সবকিছু।

আমার গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে সুন্দরবন ও নদী বেষ্টিত উপকূলীয় অঞ্চল খুলনার কয়রা । এটি নদী ভাঙ্গন,বন্যাপ্রবণ এলাকা। প্রায় প্রতিবছরই নদী ভাঙ্গনে লোনা পানি আমাদের বাড়ি ছোঁয়। কখনও কখনও তা ভাসিয়ে নেয়।সামন্য একটু বাতাস ও ঝড়ের সংকেত পেলেই নদী ভাঙ্গন আতঙ্কে কাটে গোটা উপজেলার মানুষের। আমার বিগত দুর্যোগ, বন্যার স্মৃতি সম্ভবত ২০১৯ সালের ২৫ মে  আইলা । সেটা ছিল ছোটদের জন্য উৎসবের। বাড়ির উঠানে থৈথৈ পানি। বড়দের টেনশন আমাদের ও ছোটদের ছোঁয়নি। ঘরের দাওয়ায় বসে পানি ছোঁয়া যায়,বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে টুকটাক নেমেও পড়ে ছোটরা , এটাই তাদের উৎসব। তবে সাধারণ মানুষ,ও নিম্ন আয়ের মানুষের ২০০৯ সালের মহাপ্রলয় আইলা আমাদের ভুগিয়েছে অনেক। তখন দেখেছি মানুষের দুর্ভোগ। আমার স্মৃতিতে ২০০৯ সালের নদী ভাঙ্গনের প্রকপ  সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী। আমাদের পাশের বাড়ির লোকজন তখন তাদের ঘর ভেঙে নতুন ঘর বানাচ্ছিল। সে কারণে তারা সেদিন উঠানে পাটি আর কাথা বিছিয়ে শুয়েছিল। হঠাৎ মাঝরাতে নদী ভাঙ্গনে পানি এসে ভাসিয়ে নেয় তাদের। সেই যে সন্ধায় নদী ভেঙ্গে মাঝ রাতে  পানি এলো, তারপর আর নামার নাম নেই।২ বছরের বেশি স্থায়ী হয়েছিল সেবারের দুর্ভোগ। কয়রা উপজেলা প্রধান প্রধান সড়ক পানিতে ডুবেছিল দিনের পর দিন।লোকজন আশ্রয় কেন্দ্র, উঁচু স্থানে টোং ও মাচা তৈরি করে থাকতো,  লুঙ্গি পড়ে আমরা রওনা দিতাম। আস্তে আস্তে পানি বাড়তো, লুঙ্গি ওপরে উঠতো, একসময় লুঙ্গি এক হাতে নিয়ে সাঁতরে পেরিয়ে যেতাম। আবার আস্তে আস্তে পানি কমতো, লুঙ্গি নামতো। এভাবে সেই রাস্তায় রাজ্যের মানুষ গিজগিজ করতো। শুধু মানুষ নয়, এলাকায় সব গবাদিপশুর ঠাঁইও সেই এক চিলতে রাস্তায়। আমরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতাম দল বেঁধে নৌকায় দূরে কোথাও গিয়ে। এখন হাস্যকর শোনালেও, এসবই বন্যার সময়কার বাস্তবতা। আমরা তবু এভাবে সামাল দিতাম। কিন্তু বাড়ির নারীরা কিভাবে রান্না করতেন বা অন্যান্য দৈনন্দিন কাজ, প্রকৃতির ডাক  সারতেন তখন খোঁজ নেইনি খোঁজ নেওয়া ও লজ্বার । এখনও ভাবলে অবাক লাগে, প্রশ্নের উত্তর পাই না। ২০০৯ সালের নদী ভাঙ্গন দুর্ভোগ ২ বছর জনগণ পোহালেও  টেকসই বেড়িবাঁধ  নির্মাণ করা হয় নি। তার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটি কোটি টাকা খরচ করে বেঁড়িবাধে জোড়াতালি দিলেও টেঁকসই বাঁধ হয়নি কাটেনি আতঙ্ক।

২০০৯ সালের ২৫ মে এসেছিল সর্বনাশা আইলা।  তার ১১ বছর পর সেই মে মাসের ২০ তারিখ রাতে আসছে আম্পান। আইলার জলোচ্ছ্বাসে ফসল ও প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি এ এলাকার মানুষ। কৃষিজমিগুলো আবাদযোগ্য হওয়া মাত্রই আবার ভাঙ্গন । খাবার পানির তীব্র সংকট।

আবার ও ২০২০ সালের ২০ মে থামানো যায়নি সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় আম্পনের তান্ডবে  ভঙ্গর বেঁড়িবাধ ভেঙ্গে নদীর পানি  ভয়াবহতা থেকে।বেঁড়িবাধ ভেঙ্গে লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, জমি ও মাছের ঘের। এতে নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল, ভেসে গেছে ঘেরের মাছ। ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি টাকা। এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের উপার্জনের প্রধান মাধ্যম কৃষি ও মাছ চাষ। কিন্তু ১৩ দিন আগে এই উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডব।  সহায় সম্বল হারিয়ে অসহায় দিন কাটাচ্ছে কয়রাবাসী।বেঁড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় ঘর-বাড়ি।  এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে  উপজেলার অধিকাংশ এলাকা।টেঁকসই বেড়িবাঁধ থাকলে এ অবস্থা হতো না।একবেলা খেতে পারলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকছে।অনেকের  কিছুই নেই, খুব সমস্যায় আছে।ঝড় বা সাইক্লোনের মতো বন্যার আঘাত তাৎক্ষণিক নয়। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা নানামুখী দুর্যোগ ডেকে আনে। সে দুর্যোগের প্রভাব থাকেও দীর্ঘদিন। বন্যার সময় খাবার অভাব, পানির অভাব তো আছেই; আছে নিজেদের এবং গবাদি পশুর থাকার সমস্যা। বন্যা কেটে গেলেও দুর্ভোগ কাটে না। বরং তখনই শুরু হয় আসল সমস্যা। পানি নেমে যাওয়ার পর শুরু হয় পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসল। তাতে প্রান্তিক মানুষের ঘরে খাবারের অভাব দেখা দেয়। তাই বন্যার সময় তো বটেই, বন্যার পরও দুর্গত মানুষের পাশে থাকা জরুরি। বন্যা দারুণ এক সাম্যবাদী দুর্যোগ। ধনী-গরিব সবাইকে সমান ভোগান্তিতে ফেলে।

অবস্থানগত কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়তে হয় আমাদের। কিন্তু বন্যা নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু কখনও কখনও মানুষও তাতে ভূমিকা রাখে। যেমন আমরা সারা বছর টেঁকসই বেঁড়িবাধের কথা বলি। নদী ভাঙ্গন সমস্যা এ অঞ্চলের মানুষের আজকের না দীর্ঘদিনের কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্টরা এ অঞ্চলের জনগনের  দীর্ঘ দিনের সমস্যার সমাধান করেনি। হয়নি টেঁকসই বেঁড়িবাধ।  নদী ভেঙ্গে  লোকালয় পানি আসলে সবাই তোড়জোর শুরু করে দায় সারা পানি আটকায়। কিন্তু আবার কোন ঝড় বা দুর্যোগ এলেই নদী ভেঙ্গে আমরা  ভেসে যাই।আমরা দেখি পানি মুক্ত করার থেকে এখন বেঁড়িবাধ  নিয়ে আমরা অপরাজনীতি শুরু করি কিছু কিছু মানুষ ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য। কয়রা বেঁড়িবাধ নিয়ে রাজনীতি ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করে বিশ্ব বাসি আজ অবহিত কয়রা কিছু মানুষের মানসিকতার পরিচয়।স্থানীয় এমপির নির্দেশনায় জনপ্রতিনিধ, তরুণ সমাজ, ও এলাকাবাসী  স্বেচ্ছাশ্রমের  মাধ্যমে কয়েকটি পয়েন্টে পানি আটকালেও একদিন পর তা আবার ভেঙ্গে যায়৷ বর্তমানে  উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক  মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে ।পানি বন্ধী বন্যার্তদের  তাৎক্ষণিক ত্রাণ যেমন দরকার, তেমনি দরকার দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা। তাৎক্ষণিক সহায়তার মধ্যে আছে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, ওষুধ, কাপড়। দীর্ঘমেয়াদী সহায়তায় লাগবে ঘর বানানোর উপকরণ, সার-বীজ- পুরনো ঋণের কিস্তি মওকুফ, প্রয়োজনে নতুন ঋণ। তাই সরকার এবং পাশপাশি সব বেসরকারি সংগঠনকে সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এখনই।

দুর্যোগে যেমন আমরা সবার চেয়ে এগিয়ে, দুর্যোগ মোকাবিলায়ও আমরা বিশ্বসেরা। বরং সারা বছর আমরা বিভক্ত থাকলেও, দুর্যোগ আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে। আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা করি। দুর্যোগ আমাদের ভেতরের মানুষটাকে বের করে আনে। দুর্যোগের সময় দুর্গত এলাকায় অপরাধ কমে যায়। খুন-ধর্ষণ-চুরি-ডাকাতি সব বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, মানুষ পুরনো শত্রুতা ভুলে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ায়।ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে নেমে আসতে হবে।  আবার সময় এসেছে আমাদের জেগে ওঠার। ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তোলার। সব অমানবিতা, পাশবিকতাকে বানের জলে ভাসিয়ে দেওয়ার।

এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। এখন ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর নানা উদ্যোগ সক্রিয় হচ্ছে। সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেও সক্রিয় হতে হবে। আমাদের সবার পক্ষে তো আর বন্যাদুর্গত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের ব্যক্তি উদ্যোগগুলোকে কোনও সাংগঠনিক উদ্যোগের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে ছোট ছোট উদ্যোগগুলোকে সমন্বিত কোনও বড় উদ্যোগের অধীনে আনতে হবে। তারপর কোথায় কতটুকু দরকার তা মূল্যায়ন করে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। তবে দুর্যোগের সময় মানবিকতার ফসল যেমন ফলে, তাতে কিছু আগাছাও জোটে। তাই নিশ্চিত হয়ে নিন, আপনার অর্থ বা ত্রাণ ঠিক লোকের হাতে যাচ্ছে কিনা।

সাধারণত এ ধরনের  দুর্যোগে যা হয়, কাছাকাছি এলাকার মানুষ বারবার ত্রাণ পান। আর যারা একদম প্রান্তে থাকেন, তাদের কাছে কেউ যান না, অত কষ্ট কেউ করতে চান না। তাই চেষ্টা করতে হবে সবার কাছে সমানভাবে ত্রাণ পৌঁছানোর। যার যেটা দরকার তাকে সেটাই দিতে হবে। শুধু ত্রাণ বিতরণ করলাম, এই আত্মতুষ্টিতে যেন না ভুগি আমরা।

এবার আমাদের সামনে আরেকটা বড় সুযোগ আছে। সামনেই পবিত্র ঈদুল আযহা। প্রতিবার ঈদুল আযহায় আমাদের দেশে একটা ‘দেখনদারির’ প্রতিযোগিতা হয়- কার গরু কত বড়, কোনটার দাম বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই এবার এই ‘দেখনদারি’টা আরও বেশি হওয়ার কথা। আমরা যদি জরুরি কোরবানিটা ছাড়া ‘দেখনদারি’টা একটু কমাতে পারি, বেঁচে যাওয়া অর্থটা যদি ব্যয় করি পানি বন্ধী বন্যার্তদের সাহায্যে, তাহলে বেঁচে যাবে অনেক মানুষ। সম্ভব হলে জরুরি কোরবানিটা যদি কোনও বন্যাদুর্গত এলাকায় করে মাংসটা দুর্গত মানুষের মাঝে বিলি করা যায়, তাহলে আরও ভালো হয়। আরেকটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার, দেশের অনেক কৃষক সারাবছর গরু পালে কোরবানির সময় ভালো দামে বিক্রির আশায়। কিন্তু এখন খাবারের অভাবে হয়তো প্রিয় পশুটিকে পানির দরে বেঁচে দিতে হবে। প্লিজ সম্ভব হলে আপনি আপনার কোরবানির পশুটি কিনুন দুর্গত এলাকার মানুষের কাছ থেকে, তবে ন্যায্য দামে। বন্যার সুযোগে যেন আমরা তাদের না ঠকাই। সমাজে অসংখ্য ভালো মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু সুযোগসন্ধানীও, যারা বন্যার পদধ্বনি শুনতে পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়, স্টক করে। তেমন সুযোগসন্ধানির দেখা পেলে তাকে প্রতিরোধ করুন।

প্রতিবার বন্যা বা এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয় এবং সমন্বয়হীনতার কারণে তার অপচয়ও হয়। এই দিকে নজর রাখার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। পানি নেমে যাওয়া মানেই কিন্তু বন্যার দুর্ভোগ শেষ হওয়া নয়। আসল দুর্ভোগ শুরু হয় তখনই। তাই তাদের পাশে সবাইকে থাকতে হবে শেষ পর্যন্ত।