কামান না মশা – কে বেশী শক্তিশালী?

0
707

খুলনাটাইমস ডেস্ক:
‘মশা মারতে কামান দাগানো’ একটি বিদ্রুপাত্নক প্রবাদ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। মশাকে এবং এর ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করতেই এই প্রবাদ। মনে করা হচ্ছিল যে মশা এত ক্ষুদ্র এবং দূর্বল একটা প্রাণী যে একে হাত দিয়ে তাড়ানো বা মেরে ফেলা যায়, কয়টা নারিকেল ডাল-পাতার শলা দিয়ে হাতে তৈরী হালকা ঝাড়– দিয়ে মারা যায় বা কিছু স্প্রে করে বা কয়েল জ্বালিয়ে মশাকে পরাভূত করা যায়। মশার জন্য বাতাসই যথেষ্ট আবার অন্য অস্ত্রের কি দরকার! কামানতো মানুষ মারার জন্যও নয়। তবে কেন মশা মারতে লাগবে। কামান দাগিয়ে বিশাল স্থাপনা, শহর-বন্দর, অস্ত্র কারখানা, দুর্গ ইত্যাদি ধ্বংশ করে শত্রু বাহিনীকে ধ্বংশ বা পরাজিত করা হত। মানুষের জন্যতো প্রাচীনকালে তলোয়ার বা ছুরি এবং বর্তমানে গুলিই যথেষ্ট বা ছোট অস্ত্র দিয়েই সম্ভব যাকে সামরিক বাহিনীতে ক্ষুদ্রাস্ত্র বলা হয়। এই সাধারণ বা নগণ্য শত্রুকে বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বড় কোন অস্ত্র বা জনবলের দরকার হয় না, এটি বুঝাতেই ‘মশা মারতে কামান দাগানো’-এর উদাহরণ দেয়া হত। কিন্তু এখন এ ধারণা সম্ভবত: পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয়ও এই প্রবাদে নিহিত আছে। তা হল, মশাকে কামান দিয়ে মারা সম্ভব নয়। কেন না বড় অস্ত্র দিয়ে মশাকে লক্ষ্যবস্তু করা যায় না। মশা কোন স্থির বস্তু বা বৃহৎ প্রাণী নয়। তাই তাকে কোন সামরিক অস্ত্র দিয়ে টার্গেট করে পরাভূত করা যায় না। তাই মশা মারতে কামান দাগানো একটা নিষ্ফল চেষ্টা। কিন্তু যা বলেছিলাম, এই ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে, কেন ? কারণ এখন আর মশা কোন ক্ষুদ্র বা দূর্বল প্রতিপক্ষ নয়। সারা বিশ্ব অস্ত্র বা সন্ত্রাসের মাধ্যমে বছরে যত লোক মারা যায় মশা বাহিত ডেংগু রোগে তার চেয়ে কম প্রাণহানি হয় না। আবার মশা নিধণ এবং ম্যালেরিয়া, চিকণগুনিয়া এবং ডেংগু প্রতিরোধে কামান তৈরী বা আমদানীর চেয়ে কম খরচ হয় না। এখন ডেংগু সারা বিশ্বের এক মহামারী, বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায়। বাংলাদেশে এবার তাই হচ্ছে। মূলত: ডেংগু জ¦র একটি এডিস মশা বাহিত ডেংগু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ।

মশাকে অবহেলা করা বা এর বিধ্বংশী আক্রমনকে উপেক্ষা করা বা আমলে না নেয়ার ফলে আমরা আজ পর্যুদস্ত। ঈদের আনন্দকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে এই মশা-স্ত্রী জাতীয় এডিস ইজিপ্টি মশা। রাজধানীর হাসপাতালে ঠাঁই নেই গত মধ্য জুন থেকে। সরকারী হিসেব মতেই আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৫০ হাজার ডেংগু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালগুলোতে। এ পর্যন্ত শুধু ঢাকা মহানগরীতেই ডেংগুর রোগী ছিল। কিন্তু জুলাই ২০১৯-এর শেষভাগ থেকে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেংগুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। কেন না, ডেংগুর উৎপত্তি বা শুরু ঢাকাতে হলেও ডেংগুর জীবানু নিয়ে ভ্রমণের কারণে মফ:স্বলেও রপ্তানী হয়েছে এই জীবানু ও রোগ। একইভাবে আন্ত:মহাদেশীয় ভ্রমণের ফলে এখন ইউরোপ-উত্তর আমেরিকায়ও ডেংগুতে আক্রান্ত রোগী আছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যপী ৪০ লক্ষ ডেংগুর আক্রমণ ঘটে। বিশ্বব্যপী ডেংগুর বিস্তারটি গত তিন দশক ধরে চলছে। ১৯৭৯ সালে এডিস জীবাণু প্রথমে ইউরোপের আলবেনিয়াতে রির্পোট করা হয়েছিল, তবে সন্দেহ করা হয়েছিল ১৯৭৬ সালেই। ১৯৮৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও পরে ৩২টি অংগরাজ্যে এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সমুদ্র বেষ্টিত দেশগুলো-অস্ট্রেলিয়া থেকে লাওস, সিংগাপুর থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত সরকারগুলো ডেংগুর প্রকোপ ঠেকাতে গলদঘর্ম হয়েছে সম্প্রতি। ঢাকার ডেংগুর প্রথম প্রাদুর্ভাব হয় ২০০০ সালে। তবে ১৯৯৬ সালে খুব সীমিত আকারে ডেংগু দেখা গিয়াছে। বাংলাদেশ শুরুতে এই আশংকাকে গুরুত্ব দেয়নি যদিও বিভিন্ন জাতীয়-আন্তজার্তিক সংস্থা হুঁশিয়ারী দিয়েছিল। তাইতো আজ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এখন কামান আমদানির চেয়ে মশা নিধণের ঔষধ ও যন্ত্রপাতি আনাই বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে। আবার এটাকে নিয়ে রাজনীতি, গুজব, উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো এসবও মিডিয়াকে গরম রেখেছে। সরকারের বাঘা বাঘা মন্ত্রীরা, বিভিন্ন দলের নেতারা, উন্নয়ন সংস্থা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সবাই এ নিয়ে বেশ ব্যস্ত। পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী, এমন কি চলচ্চিত্র শিল্পীরা, নূতন নূতন সংগঠন -সবাই কর্মতৎপর হয়েছে ডেংগু দমনে। বৈশি^ক জলবায়ুর পরিবর্তনে, বিশেষ করে এর নেতিবাচক প্রভাবে বিশ^ব্যপী ডেংগু বাহিত মশার উৎপাদন বেড়েছে। উষ্ণ বা গ্রীষ্ম মন্ডলীয় অঞ্চল যেমন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ সমগ্র এশিয়া, সমুদ্র বেষ্টিত দেশসমূহ, আফ্রিকায় এডিস মশার জন্ম ও আক্রমন অধিক। আর যেসব কারণে ডেংগুর প্রকোপ বেড়েছে তার মধ্যে রয়েছে সর্বত্র নির্মাণ বিপ্লব যাকে উন্নয়ণের মাপকাঠি বলে গণ্য করা হয় যার কারণে প্রতিনিয়ত বর্জ্য-আবর্জনা, খনন কাজের জন্য পানিবদ্ধতা, গুমট পরিবেশ ইত্যাদি দ্বিতীয় উপসর্গ। পরিবেশ দুষণ ও ধ্বংশের কারণে মশা খাদক বা শিকারী কীটপতঙ্গের বিলুপ্তি ঘটায় মশককুল নির্বিঘ্নে বিচরণ করতে পারে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া নিরাপদে সংগঠিত হয়। অবশেষে জনগণের অসচেতনতা এবং কতৃপক্ষের মনিটরিং, পরিকল্পনা এবং সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নেয়াই মুখ্য কারণ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ডেংগুরর্ রাস টেনে ধরতে ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর ও চীনের মত বাংলাদেশও গলদঘর্ম। ফিলিপাইন ইতেমধ্যে এই রোগকে জাতীয় মহামারী ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সরকার যারপরও নাই কর্মতৎপর, কিন্তু এই ধরণের ঘোষণা দিলে মান যাবে বা সরকারের ব্যর্থতা প্রকাশ পাবে এই আশংকায় ভূগছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। এখন মশা, বিশেষ করে এডিস মশা মনে হয় কামানকে আর ভয় পায় না।

মশা যে একটি ঘাতক প্রাণী তাতো প্রমানিত হয়েছে হাজার হাজার বছর আগে। এই ছোট্ট একটি পতংগ তৎকালীন পৃথিবীর মহাপরাক্রমশালী বাদশাহ নমরূদকে ঘায়েল করেছিল যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দিয়ে যা সবার জানা। কেউ ভাবেনি এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীটি কখনো কখনো কতো শক্তিশালী ও বিধ্বংশী হতে পারে। একসময় মশাবাহিত ম্যালেরিয়া মশা পৃথিবীকে ব্যস্ত রেখেছিল, এখনো কম-বেশি আছে। বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস এর উপর গবেষণা করে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আমাদের নবম-দশম শ্রেণীতে ড: রসের ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত এই প্রবন্ধটি ইংরেজী বিষয়ে অন্তভূক্ত ছিল। কিন্তু রস নিজেই দু:খ প্রকাশ করেছেন যে, তাঁর সম্মান এবং খ্যাতির জন্য সব কিছু করা হয়েছে কিন্তু তাঁর সুপারিশগুলো শেষ পর্যন্ত সফলভাবে কার্যকর হয়নি। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে ১৯৭০ সালের আগে ডেংগুর অস্তিত্ব ছিল মাত্র নয়টি দেশে যা সম্প্রতি উন্নীত হয়েছে ১০০টিরও বেশী দেশে। আমাদের দেশে একসময় গুটি বসন্ত এবং কলেরা মহামারী ছিল। তখনতো চিকিৎসা ব্যবস্থা অতি সীমিত ছিল। মফ:স্বলের মানুষ ঝাড়-ফুঁক, দোয়া-তাবিজ ও লতা-পাতা অর্থাৎ বনাজী বা কবিরাজি ঔষধের উপর নির্ভর করত। আজ বসন্ত প্রায় নির্মূল। ম্যালেরিয়া পর মশার ছোবেল চিকণগুনিয়া ও ডেংগুর মাধ্যমে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া জিকা ভাইরাসও এডিস মশা বাহিত। এই কিছুদিন আগে মাত্র জিকা ভাইরাস নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। এখন আবার তা স্তিমিত। তাই মশক, বিশেষ করে এডিস মশা নিধন বা র্নিমূল করাই প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত আমাদের। ইতিপূর্বেকার সতর্কবানী আমলে না নিলেও এখন ভাববার সময় হয়েছে। এব্যপারে টেকসই পরিকল্পণা নেয়া আবশ্যক যা ক্ষণস্থায়ী নয়, দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে।
ইতোমধ্যে এডিস মশা ও ডেংগু নিয়ে অনেক আলোচনা- সমালোচনা হয়েছে। প্রথমে এটিকে সরকারিভাবে গুরুত্ব না দিয়ে গুজব বলে চালানো হয়েছে,পরে টনক নড়লেও এর ভয়াভয়তা আঁচ করা হয়নি, শেষে জানা গেল সিটি র্কপোরেশনের ছিটানো ঔষধ অকার্যকর ছিল। এই ডামাডোলের মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সপরিবারে মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে মিডিয়ায় বিরূপ মন্তব্যের মুখোমুখি হন। ফলস্বরূপ তিনি চাপে ছিলেন এবং জরুরী তলবে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর বিভিন্ন মন্তব্য সমলোচিত হয়। এছাড়া অর্থমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ণ প্রতিমন্ত্রী, একজন সিটি কর্পোরেশন মেয়রের মন্তব্য দুষ্টলোকেরা ডেংগুর আক্রমণের সাথে মশকরা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। তাঁদের মতে ডেংগুর আবির্ভাব দেশের উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত। ডেংগু দেখে বুঝতে হবে যে দেশে উন্নয়ন হয়েছে। আবার ডেংগুতে মৃতের সংখ্যা নিয়েও অনেকটা লুকোচুরি হয়েছে। সরকারী হিসাবমতে মোট মৃত ৪০ জন যা সেসরকারীভাবে ১৪৫ জন (দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ আগস্ট ২০১৯)। ১৮ আগস্ট ঢাকাতে এক হাসপাতালে মারা যায় ৩ জন। দৈনিকই এই সংখ্যা বাড়ছে। আবার এটিকে আজাব-গজব বলেও কথা উঠেছে এবং মসজিদে মসজিদে এই গজব থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করানো হচ্ছে। এটিও ঠিক যে বিপদে-আপদে, আজবে-গজবে আল্লাহর কাছে পানা চাওয়া প্রয়োজন।
ডেংগু নিয়ে এত কথা চালাচালি হলেও এটি আসলে কি তা পরিষ্কার হওয়া দরকার। ডেংগু একটি ভাইরাস যা মশা বাহিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় একটি রোগ। যে মশাটি ডেংগু ভাইরাস (Dengue virus) বহন করে বা ছড়ায় তা একটি স্ত্রী জাতীয় এডিস মশা যাকে এডিস ইজিপ্টি (Aedes aegypti) মশা বলা হয়। এটি এমন একটি মশা যা ডেংগু জ¦র, বাত জ¦র, চিকণগুনিয়া, জিকা জ¦র, মায়াবো এবং অন্যান্য রোগের জীবাণূ ছড়াতে পারে। গত বছর বাংলাদেশে চিকণগুনিয়া বেশ প্রকট ছিল যার রেশ অনেকদিন থাকে, এমনকি বছর বছর পর্যন্ত। এই এডিসের আবার বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। দুই প্রকার এডিস দ্বারা এই রোগ সংক্রমিত হয়-এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবো পিকটাস (Albopictus)। এটি একটি স্বতন্ত্র ধরণের মশা যার দেহে ও পায়ে কালো ও সাদা চিহ্ন রয়েছে অনেকটা চিত্রা বা ডোরাকাটা। এজন্য এটিকে টাইগার মশাও বলা হয়। এই এডিস মশাকে গৃহপালিত মশাও বলা হয়। কারণ, এটি রাতে বা অন্ধকারে সোফা, ঘরের চিপাচাপায় লুকিয়ে থাকে। এটি শুধু দিনের বেলায় কামড়ায় তবে রাতে উজ্জল আলোতেও কামড়াতে পারে। এখনতো শহরে দিনে-রাতে পার্থক্য কম। খুব ভোরে সূর্য উদয়ের সময় এবং সন্ধ্যা হওয়ার প্রাক্কাল হলো কামড়ানোর শীর্ষ সময়। আবার এডিস ইজিপ্টিকে শহুরে এবং এডিস এ্যালবোপিকটাসকে গ্রাম্য বা বুনো মশা বলা হয়। ১৯টি জায়গায় এই মশা বেশী বসবাস করে থাকে যেসব ক্ষুদ্র আধারে পানি জমা হয় এবং ফ্রেশ পানিতেই এর লার্ভা বেশী জন্মে এক সপ্তাহকালের মধ্যে। জ¦র দিয়ে শুরু হয়, কাশি, মাথাব্যথা, চোখব্যথা, লাল র‌্যাশ, বমি, পাল্স্ বা নাড়ীর স্পন্দণ ও রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার নেমে যাওয়া, রক্তের প্লেটিলেট (blood platelets) অতিমাত্রায় নেমে যাওয়া, কখনো কখনো রক্তক্ষরণ – এসব হল ডেংগুর লক্ষণ। তবে সব সময় এবং সবার ক্ষেত্রে এসব লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মুল করাই এর থেকে মুক্তির উপায়। তবে শুধু ঔষধ ছিটালেই এর উৎপাটন হবে না। এর সংগে অন্যান্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, যেমন, কোথাও পানি জমতে না দেয়া, প্রয়োজনে দিনের বেলায়ও মশারী টানানো, হাত পা খালি না রেখে ফুলহাতা জামা ও ফুল প্যান্ট বা পাজামা মোজা ব্যবহার করা, ঘরে মশা যেন না থাকে সে জন্য স্প্রে, বৈদ্যুতিক ব্যাট ও যন্ত্র, মশা নিরোধক ক্রিম ইত্যাদি ব্যবহার করা। একটি কথা মনে রাখা দরকার যে কেবল কামড়ালেই ডেংগু হবে না যদি না তার মধ্যে ভাইরাস থাকে এবং সংক্রমিত হওয়ার মত পরিবেশ থাকে। তবে দুই মিলিলিটার পানিই ডিম পাড়ার জন্য যথেষ্ট। পরিত্যাক্ত ও অবহেলিত আধারেই এডিস স্ত্রী মশা ডিম পাড়ে এবং অনেকদিন এই ডিম জিবিত থাকে। সরকার প্রতিষ্ঠিত আই ই ই ডি সি আর (রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান-Institute of Epidemiology Disease Control and Research) ডেংগু মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটির মাধ্যমে ডেংগু মৃত্যুর বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে যে ডেংগুতে আক্রান্ত হয়ে রোগীদের শক সিন্ড্রোম বা আতংক হয় এবং মৃতদের ৬৮% এই শক সিন্ড্রোমের কারণ। এই শক সিন্ড্রোমের লক্ষণ হল রক্তক্ষরণ এবং পানি শূণ্যতার কারণে রোগী অচেতন হয়ে পড়ে।
এডিস মশা জন্মের পর সাধারনত: ৫ দিনের মত সময় লাগে পরিপূর্ণ হতে। ছয় দিনের আগে এডিস মশা বাড়তে পারে না। এরপর তারা ডিম পাড়ে যা ৭ থেকে ১০ দিনের মতো সময় বেঁচে থাকে। এসময়ের মধ্যে ভাইরাস আক্রান্ত স্ত্রী জাতীয় মশা কামড়ালে ডেংগু বা চিকণগুনিয়ার আশংকা থাকে। ম্যালেরিয়া জীবানু বহনকারী কিউলেক্স ও অ্যানোফিলিস মশা একবার কামড়ালেই রক্ত চুষে নেয়, কিন্তু এডিস চার পাঁচ জন মানুষ থেকে একটু একটু করে রক্ত নেয় এবং জীবানুবাহিত মশায় পরিনত হয়। নূতন সমীকরণে জানা যায় যে আগে ডেংগু ছিল একরকম, এখন চার রকম ডেংগু ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। ভবিষ্যতে বাড়ে কিনা কে জানে অথবা মশাবাহিত অন্য কোন রোগের প্রাদুর্ভাব হয় কিনা তাওতো নিশ্চিত করে বলা যায় না। আবার মশার নূতন কোন প্রজাতিও দেখা যেতে পারে। প্রকৃতিকে যতই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই প্রকৃতিও ততই নূতন নূতন রোগ বা উপসর্গ দিয়ে আমাদেরকে কাবু করার প্রয়াস চালায়। অনেক রহস্যই আমাদের অজানা এবং তা কোনদিন শেষ হবে না। কেননা, বিধাতা আমাদের তাঁর মহাজ্ঞানের অতি অল্প কিছুই দিয়েছেন, অথচ আমরা নিজেদের অনেক জ্ঞানী মনে করি।
ডেংগুর আরেকটি বিশেষ দিক হল এর ধরণ কখনো কখনো পরিবর্তিত হয়। ডাক্তারী ভাষায় ক্লাসিক্যাল থেকে হিমোরোজিক ফিভারে রূপ নিতে পারে এবং প্রথমবার হওয়ার পর আবারও হতে পারে যা আরো জটিল হতে পারে। ২০০০ সাল এবং ২০১৮ সালের ডেংগুতে যেমন পার্থক্য ছিল, ২০১৯ সালের ডেংগুতেও নূতন নূতন লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায়। অথাৎ ডেংগুরও বিবর্তন হচ্ছে সময়ে সময়ে। তাই রাজনীতি না করে অন্যের ঘাড়ে দোষ না দিয়ে ডেংগুর প্রতিরোধ এবং মশা নির্মূলের ব্যবস্থা নেয়াই সরকারের এবং বিভিন্ন সংস্থার কাজ। এই সংগে সমগ্র জনগণ সচেতন ও সম্পৃক্ত না হলে সুফল পাওয়া যাবে না। সিটি কর্পোরেশনের ঔষধ আমদানী ও ক্রয়ে দূর্নীতির আভাস পাওয়া গিয়েছে। তা থেকে মুক্ত হয়ে কার্যকর ঔষধ ক্রয় এবং তা হতে হবে দ্রুত ও সময় মত। ডেংগু প্রতিরোধে করণীয়-অকরণীয় বিষয়ে জনগণকে সতর্ক ও প্রশিক্ষিত করা এবং প্রচারকার্য অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। ডেংগুর প্রাদুর্ভাবকাল মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে যা প্রকট হয় জুন থেকে। তাই এর আগেই প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা আবশ্যক। নিজ এলাকা ও বাসস্থান কিভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ডেংগুমুক্ত করা যায় সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা এবং কর্তৃপক্ষ কর্র্তৃক সময়োচিত ব্যবস্থা নেয়াই ডেংগু থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়। জাতীয় ডেংগু ব্যবস্থাপণা নির্দেশিকা অনুসরণ করে চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। যেহেতু ডেংগু এবং চিকণগুনিয়া জটিল রোগ এবং এর বির্বতন হয় তাই হাসপাতালগুলোতে সঠিক চিকিৎসা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করার জন্য গবেষণা সেল গঠন করা দরকার এবং সে অনুযায়ী ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ ও অবহিত করণের ব্যবস্থা রাখাও প্রয়োজন। কেননা সামরিক কামান দিয়ে যা হয় না চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কৃত প্রতিরোধ কামান দিয়ে মশক কুলকে দমন করতে হবে। তা না হলে চলতি প্রবাদ অনুযায়ী মশা মারতে কামান দাগানোর মত নিষ্ফল প্রচেষ্টা কোন কাজে আসবে না।